শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে সমাধী খুজে পাইনি সাংস্কৃতিক জোট ও ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি
ডি এইচ দিলসান : ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ যশোরের প্রথম শহীদ চারুবালা করের সমাধীতে ফুলের শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে সমাধী খুজে পাইনি যশোর জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।
মঙ্গলবার চারুবালা করের হত্যা বার্ষিকীতে সেখানে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে গিয়ে যশোর জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেতৃবৃন্দ দেখেন সমাধি উধাও। পরে সেখান থেকে ফিরে এসে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আরিফকে অবহিত করেন নেতৃবৃন্দ। পরে বকুলতলাস্থ ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতি ম্যুরালে প্রতীকি শ্রদ্ধাঞ্জলি জানান তারা।
স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরর আগে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে যশোরের মুক্তিকামী মানুষ, উত্তাল যশোরে সেদিন পাক বাহিনীর বিপক্ষে মাঠে নামে, সেই গন জুয়ারে নীর্বিচারে গুলি করে হানাদার বাহিনী। আর সেই গুলিতে যশোরের প্রথম শহীদ হন চারুবালা কর। কিন্তু স্বাধীনতার ৪ যুগ বছর পার হয়ে গেলেও আজ পর্যন্ত সেই শহীদের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মান করতে পারিনি কেউ, অযতেœ অবহেলায় চারুবলার কবের উপর দিয়ে এখন উঠেছে দখলদারদের ইমারত, শেষ চিহ্নটুকুও নেই আর। দখল হয়ে গেছে সমাধির আশপাশের জায়গাও। অথচ তার মৃত্যুর পর যশোর অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছিল। স্বাধীনতার দাবিতে মানুষ মাঠে নেমেছিল। সেই দিনটির কথা কেউ মনে রাখেনি। স্বাধীনতা যুদ্ধের বীজ উপ্ত হয়েছিলো চারুবলা করের লাশের উপর দিয়ে।
সরজমিনি গিয়ে দেখা গেছে নীলগঞ্জ মহাশ্মসানের পাশে নদীর ধারে প্রগতী বালিকা বিদ্যালয়ের পেছনে মাটির সাথে মিসে আছে চারুবালা করের কবরটি, যার উপর দিয়ে বাড়ি তুলেছেন নীলগঞ্জ এলাকার জসীমের ভাই। শেষ চিহ্নটুকুও আর নেই সেখানে।
সেদিনের মিছিলের প্রত্যাক্ষদর্শী বীর মুক্তিযোদ্ধা ইয়াকুব কবির জানান ৩ মার্চ সকাল সাড়ে ১০টা। স্বতঃস্ফূর্ত জনতার বিশাল মিছিল বের হয় ঈদগাহ ময়দান থেকে। দড়াটানা মোড় ঘুরে কাপুড়িয়াপট্টি-চৌরাস্তা হয়ে মিছিলটি ঢোকে রেল রোডে। সেদিন সেই মিছিলে ছিলেন, বিএলএফ প্রধান আলী হোসেন মনি, জাসদের সহ সভাপতি রবিউল আলম, রওশন আলীসহ আরো অনেকে। মিছিলটি সরকারী খাদ্য গুদামের সামনে পাক হানাদার বাহিনীর অবস্থান দেখে তাদের দিকে ইট ও জুতা নিক্ষেপ করে উত্তেজিত জনতা। ওই সময় এক পাকসেনা বিক্ষুব্ধ জনতাকে ভয় দেখাতে ফাঁকা গুলি ছোঁড়ে, গুলিবিদ্ধ হয় আকাশে ভেসে বেড়ানো এক চিল। মৃত চিলটিকে নিয়ে মিছিলটি ঢোকে ভোলা ট্যাঙ্ক সড়কে। সার্কিট হাউসের ভেতরে পাক সেনাদের দেখে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে জনতা। তারা সার্কিট হাউস আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। এ সময় তৎকালীন পাকিস্তন জাতীয় পরিষদের সদস্য স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম সংগঠক শহীদ মশিয়ুর রহমান বিক্ষুব্ধ জনতাকে শান্ত করে ফিরিয়ে নিয়ে যান ঈদগাহ ময়দানে। বিভিন্ন মহল্লা থেকে বিক্ষুব্ধ মানুষ তখনও জড়ো হচ্ছিল সেখানে। এর পর দুপুর ১২টার দিকে হানাদার বাহিনীর গাড়ি ঈদগাহের পাশের রাস্তা অতিক্রম করার সময় জনতা আবারও উত্তেজিত হয়ে ওঠে। জনতার দিকে অস্ত্র তাক করে হানাদাররা। নেতৃবৃন্দের হস্তক্ষেপে শান্ত হয় জনতা। ওই সময় খবর আসে টেলিফোন ভবন দখল করে নিয়েছে হানাদার বাহিনী। চরম উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে উপস্থিত ছাত্র-জনতার মধ্যে, উত্তেজিত ছাত্র-জনতার একটি অংশ ঈদগাহ ময়দান থেকে বেরিয়ে টেলিফোন ভবনের সামনে গিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এ সময় কোন পূর্ব সতর্কীকরণ ছাড়াই টেলিফোন ভবনের ছাদ থেকে জনতার দিকে মেশিনগান দিয়ে গুলিবর্ষণ শুরু করে হানাদার বাহিনী। টেলিফোন ভবনের পশ্চিম পাশে বসবাস করতেন নিঃসন্তান পূর্ণ চন্দ্র কর ও তার স্ত্রী চারুবালা কর। হানাদার বাহিনীর ছোঁড়া বুলেট ঘরের গোলপাতার ছাউনি ভেদ করে বিদ্ধ হয় চারুবালা করের ঘাড়ে। শহীদ হন তিনি।
হানাদার বাহিনীর নির্বিচার গুলিবর্ষণে আহত হন অনেকে। চারুবালা করের মরদেহ নিয়ে রাখা হয় যশোর সদর হাসপাতাল মর্গে। মর্গে তালা লাগিয়ে পাক সেনারা অবস্থান নেয় সেখানে। বাইরে হাজার হাজার মানুষ চারুবালা করের মরদেহ নেয়ার অপেক্ষায়। কিন্তু পাক সেনারা মরদেহ দিতে নারাজ। অপেক্ষমাণ মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙতে শুরু করে। ক্রমেই উত্তেজিত হয়ে ওঠে মানুষ। এমন সময় মশিয়ুর রহমান মুখোমুখি হন পাক সেনা অফিসারদের। বজ্রকণ্ঠে তিনি বলেন, আমার মায়ের মরদেহ আমি নিয়ে যাব, তোমরা ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। মুহূর্তে জনতা মর্গের তালা ভেঙ্গে বাইরে নিয়ে আসে চারুবালা করের মরদেহ, সূর্য তখন অস্তগামী, সৎকারের জন্য শহীদ চারুবালা করের মরদেহ নিয়ে হাজার হাজার মানুষ ছুটছে নীলগঞ্জ মহাশ্মশানে, শবযাত্রায় পুরুষের সঙ্গে যোগ দেয় বহু নারী। সবার চোখে মুখে প্রতিরোধের প্রতিচ্ছবি। নীলগঞ্জ মহাশ্মশানে সমাধিস্থ করা হয় শহীদ চারুবালা করের মরদেহ।
এ ব্যাপারে যুদ্ধকালীন বিএলএফ লিডার রবিউল আলম বলেন, আমরা অনেক দিন ধরে চেষ্টা করছি যশোরের প্রথম শহীদ চারুবালা করের সমাধীস্থলে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করতে, তার জন্য আমরা বীগত সকল জেলা প্রশাসকের দারস্থ হয়েছি, কিন্তু কোন রকম সাহায্য পাই নি। তবে তিনি বলেন, খুব শিগ্রই আমরা স্মৃতিস্তম্ভটি করবো।
এ ব্যাপারে যশোরের বীর মুক্তিযোদ্ধা সেদিনের মিছিলের অগ্রনী সৈনিক ইয়াকুব কবির বলেন, চারুবালা কর বাংলাদেশের মানুষের কাছে হিন্দু নয়, মুসলিম নয়, বেীদ্ধ নয়, খ্রিস্টান নয়, তিনি একজন শহীদ হিসেবে পরিচিত। হাজার হাজার মানুষ সেদিন তাকে মিছিল সহকারে এনে সমাধি করা হয়। আমরা এ যাবৎ অনেক জেলা প্রশাসককে এনে দেখিয়েছি, বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যাক্তিদের এনছি, কেউ তার স্মৃস্তিম্ভটি সংরক্ষন করা হয়নি। তিনি বলেন, সরকারি খাস জমি হওয়ায় প্রভাবশালীরা দখল করে চারুবালা করের বুকের উপর দিয়ে বাড়ি ঘর নির্মান করছে। তিনি বলেন, জেলা প্রশাসক, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, এমপি, মন্ত্রীদেরও বলার পরও কিছু হয়নি।
এ ব্যাপারে নীলগঞ্জ মহাশ্মশানের সাধারণ সম্পাদক যোগেশ দত্ত বলেন, আমি বিগত ২৪ বছর ধরে এই শ্মশানের দায়িত্বে আছি, এই পর্যন্ত চারুবালা করের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মানের জন্য জেলা প্রশাসক বরাবর ৫টি ফাইল দিয়েছি, ধন্না ধরেছি মুক্তিযোদ্ধা সংসদে, গিয়েছি এমপি, মন্ত্রীদের কাছে, কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি, তিনি বলেন, আগামী প্রজন্মকে এই চারুবালা কে ছিলেন সেটা জানানোর জন্য হলেও একটি স্মৃতিস্তম্ভ করা দরকার।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেতা সাজেদ রহমান বলেন ২০১০ সালের মার্চে রিপোর্ট করার জন্য গিয়েছিলাম যশোর শহরের নীলগঞ্জ মহাশ্মশানে। তখনও ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে যশোরে প্রথম শহীদ চারুবালা করের সমাধি। কিন্তু আজ তাঁর হত্যা বার্ষিকীতে সেখানে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে গিয়ে দেখি দখলদাররা তা দখল করে নিয়েছে, চিহ্ন টুকু নেই আর।
যশোর জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের নেতা সানোয়ার আলম খান দুলু বলেন, যশোরের প্রথম শহীদ চারুবালার বুকের উপর দিয়ে প্রাচির তুলেছে দখলদারেরা। আমরা যশোর জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট গিয়েছিলাম তার সমাধিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিতে, কিন্তু সমাধি উধাও, সমাধীর চিহ্ন নেই। পরে সেখান থেকে ফিরে এসে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আরিফকে অবহিত করি আমরা। এরপরে বকুলতলাস্থ ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতি ম্যুরাল’ এ প্রতীকি শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানো হয়।
তৎকালিন বিএলএফ প্রধান আলী হোসেন মনি বলেন, সেদিন আমাদের মিছিলে হানাদার বাহিনী নির্বীচারে গুলি বর্ষণ করে, আহত হয়ে আমার অনেক সহযোদ্ধা, নিহত হয় চারুবালা কর। তিনি বলেন, স্বাধীনতার এতটা বছর পার হয়ে গেলো কিন্তু আমাদের সরকার, আমাদের নেতারা কেউ এগিয়ে এলোনা এই ছোট্ট একটা কাজে। তিনি সরকারের কাছে নিবেদন করেন, শহীদ চারুবালা করের স্মৃতিস্তম্ভটি দখলদারদের কবল থেকে মুক্ত করে একটি স্মৃতিস্তম্ভ করতে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আরিফ বলেন, আমি ব্যাপারটা জানতাম না, একন যখন জানলাম অবশ্যয় আমি এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিবো। তিনি বলেন অবৈধ দখলদারদের কোন ছাড় দেওয়া হবে না।