ষোড়শ শতকের একজন বিখ্যাত রাজা ও জমিদার প্রতাপাদিত্য!!

0
439

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ প্রতাপাদিত্য, রাজা যশোরের রাজা ও ষোড়শ শতকের বাংলার একজন বিখ্যাত ভূঁইয়া বা জমিদার। তাঁর পিতা শ্রীহরি (শ্রীধর) ছিলেন কায়স্থ এবং সুলতান দাউদ খান কররানীর অধীনে একজন প্রভাবশালী রাজকর্মচারী। দাউদ খানের পতনের পর শ্রীহরি তাঁর নিকট রক্ষিত সরকারি ধনসম্পদ নিয়ে পালিয়ে যান। অতঃপর তিনি খুলনা জেলার দক্ষিণ প্রান্তে জলাভূমি অঞ্চলে এক রাজ্য গড়ে তোলেন (১৫৭৪) এবং মহারাজা উপাধি গ্রহণ করেন। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে প্রতাপাদিত্য পিতার রাজ্যের উত্তরাধিকারী হন।
বাহারিস্তান-ই-গায়েবী, আবদুল লতীফ এর ভ্রমণ ডায়েরি ও সমসাময়িক ইউরোপীয় লেখকদের রচনা থেকে প্রতাপাদিত্যের ব্যক্তিগত যোগ্যতা, তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপত্তি, বৈষয়িক সম্পদ এবং সামরিক বিশেষত নৌশক্তির প্রমাণ পাওয়া যায়। বৃহত্তর যশোর, খুলনা ও বরিশাল জেলার অন্তর্গত ভূভাগের বৃহত্তর অংশ তাঁর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। যমুনা ও ইছামতীর সঙ্গমস্থলে সামরিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান ধুমঘাটে তিনি তাঁর রাজধানী স্থাপন করেন। বাংলার জমিদারদের মধ্যে প্রতাপাদিত্যই সর্বপ্রথম মুগলদের আনুকুল্য লাভের জন্য সুবেদার ইসলাম খান এর নিকট দূত প্রেরণ করেন। তিনি বহুমূল্য উপঢৌকনসহ তাঁর দূত শেখ বদি এবং কনিষ্ঠ পুত্র সংগ্রামাদিত্যকে সুবাহদারের দরবারে পাঠান (১৬০৮ খ্রি)। প্রতাপাদিত্য পরে আলাইপুরে সুবাহদারের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে সাক্ষাৎ করবেন এই শর্তে যুবরাজ সংগ্রামাদিত্যকে সুবাদারের দরবারে প্রতিভূ হিসেবে রাখা হয়। তদনুসারে প্রতাপাদিত্য ১৬০৯ খ্রিস্টাব্দে আত্রাই নদীর তীরে সুবাদারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আনুগত্য প্রকাশ করেন। প্রতাপাদিত্য সুবাদারকে এমন প্রতিশ্রুতি দেন যে, স্বীয় রাজ্যে ফিরে গিয়ে তিনি তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র সংগ্রামাদিত্যকে ৪০০ রণতরীসহ ইহতিমাম খানের অধীনে মুগল নৌবাহিনীর সঙ্গে যোগদানের জন্য পাঠাবেন এবং তিনি স্বয়ং ২০ হাজার পাইক, ১ হাজার অশ্বারোহী ও ১০০ রনতরীসহ মুসা খানের অধীনস্থ শ্রীপুর ও বিক্রমপুরের উপর আক্রমণ পরিচালনার জন্য আরিয়ল খাঁ নদীপথে অগ্রসর হবেন। কিন্তু এ প্রতিশ্রুতি তিনি রক্ষা করেন নি। সামন্ত জমিদার হিসেবে তাঁর অনানুগত্যের জন্য প্রতাপাদিত্যকে শাস্তিদান এবং তাঁর রাজ্য পদানত করার লক্ষ্যে ইসলাম খান রণপ্রস্ত্ততি গ্রহণ করেন। সমূহ বিপদের সংবাদ পেয়ে প্রতাপাদিত্য তাঁর এ ভুল সংশোধনের ত্বরিত ব্যবস্থা নেন। তিনি তাঁর পুত্র সংগ্রামাদিত্যকে ৮০টি রণতরীসহ সুবাহদারের নিকট প্রেরণ করেন এবং তাঁর এ ভুলের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। কিন্তু ইসলাম খান এ ব্যাপারে কঠোর মনোভাব ব্যক্ত করেন এবং তাঁর রাজ্য পদানত করে তাঁকে শাস্তিদানের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি রাজার প্রেরিত রণতরীগুলো ধ্বংস করার নির্দেশ দেন। ইসলাম খান প্রতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে অভিযানের জন্য এক বিশাল বাহিনী সংগঠিত করেন। এ বাহিনীতে ছিল ১ হাজার বাছাই করা অশ্বারোহী, ৫ হাজার বন্দুকধারী আর ছিলেন মির্যা মক্কী, মির্যা সাইফুদ্দিন, শেখ ইসমাইল ফতেহপুরী, শাহ বেগ খাকসার ও লছমি রাজপুতের ন্যায় অভিজ্ঞ সেনানায়কেরা। অনুগত জমিদারদের নৌবহর ছাড়াও এ বাহিনীতে ছিল ৩০০ রাজকীয় রণতরী। ইসলাম খানের ভাই গিয়াস খানকে বাহিনীর প্রধান সেনাপতি করা হয় এবং রাজকীয় নৌবহর ও গোলন্দাজ বাহিনীর দায়িত্বে নিয়োজিত হন মির্যা নাথান। রণকৌশল হিসেবে যুগপৎ প্রতাপাদিত্যের জামাতা বাকলার রাজা রামচন্দ্রের বিরুদ্ধেও এক বাহিনী প্রেরণ করা হয় যাতে বাকলা থেকে যশোর রাজের সপক্ষে কোনো সামরিক সাহায্য আসতে না পারে। স্থলবাহিনী নিয়ে গিয়াস খান আলপসিং থেকে রওনা হন। এরপর আলাইপুরের নিকটে পদ্মা নদী পার হয়ে জেলিঙ্গি ও এর শাখা ভৈরব নদীর তীরপথে অগ্রসর হয়ে পাখওয়ানে শিবির সন্নিবেশ করেন। ১৬১১ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে সমগ্র বাহিনী ভৈরব ও ইছামতী নদীপথে যশোর অভিমুখে অগ্রসর হয় এবং অচিরেই যমুনা ও ইছামতীর সঙ্গমস্থলে সালকা নামক স্থানে পৌঁছে। মুগল বাহিনীর অগ্রগতি মোকাবেলার জন্য প্রতাপাদিত্য এক শক্তিশালী স্থল ও নৌবাহিনী সংগঠিত করেন এবং এ বাহিনীর নেতৃত্বে নিয়োজিত করেন দক্ষ ফিরিঙ্গি, আফগান ও পাঠান সেনাপতিদের। স্থল বাহিনীর এক বিশাল অংশ, রণহস্তী, গোলন্দাজ বাহিনী এবং ৫০০ রণতরীর নৌবহরসহ তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র উদয়াদিত্যকে সালকা অভিমুখে প্রেরণ করেন যাতে তিনি আগেভাগেই সালকায় সামরিক দিক দিয়ে সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান গ্রহণ করতে পারেন। উদয়াদিত্য সালকায় পৌঁছে এমন এক স্থানে দুর্গ নির্মাণ করেন যার তিন দিকেই ছিল প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা বেষ্টনী। ফলে তার অবস্থানটি হয়ে উঠে অনেকটা দুর্ভেদ্য। উদয়াদিত্যের প্রধান সহযোগী ছিলেন দু’জন দক্ষ সেনাপতি, জামাল খান ও খাজা কামাল। অশ্বারোহী ও হস্তীবাহিনীর অধিনায়ক নিয়োজিত হন জামাল খান এবং নৌবাহিনীর দায়িত্ব দেয়া হয় খাজা কামালকে। মুগল স্থলবাহিনী দুভাগে বিভক্ত হয়ে ইছামতীর দুই তীরপথে উদয়াদিত্যের দুর্গ অভিমুখে অগ্রসর হতে থাকে। উদয়াদিত্য অকস্মাৎ শত্রু বাহিনীর উপর প্রবল আক্রমণ পরিচালনা করেন। জামাল খানকে দুর্গরক্ষী বাহিনী ও হস্তীবাহিনীসহ সালকা দূর্গ প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত রেখে উদয়াদিত্য সমগ্র নৌবহর নিয়ে শত্রুর মোকাবেলায় অগ্রসর হন। তিনি শক্তিশালী নৌবহর ও ভাসমান কামানবাহী রণতরীসহ খাজা কামালকে অগ্রবর্তী বাহিনীর দায়িত্বে নিয়োজিত করে অন্যান্য নৌবহরসহ স্বয়ং মধ্যবর্তী অংশের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। যুদ্ধের শুরুতে ব্যাপক সংখ্যাধিক্যের কারণে যশোর নৌবহর বেশ সাফল্য অর্জন করে এবং মুগল নৌবহরকে অনেকটা কোণঠাসা করে ফেলে। মুগলদের অগ্রবর্তী চৌকির ২০টি রণতরী প্রচন্ড আক্রমণের শিকার হয়। যশোর নৌবহর যখন মুগলদের অগ্রবর্তী চৌকির রণতরীগুলোকে প্রায় ঘিরে ফেলতে থাকে ঠিক তখনই ইছামতীর তীর থেকে মুগল তীরন্দাজরা একযোগে তীর ছুড়ে এবং বন্দুকধারী সৈন্যরা গুলি ছুড়ে যশোর নৌবহরের অগ্রগতি প্রতিহত করে। ঠিক এই সময় মির্জা নাথান তাঁর নৌবহর নিয়ে নদীর পশ্চিম তীর বরাবর এমন তীব্র গতিতে অগ্রসর হন যে, তার নৌবহর যশোর নৌবহরকে ভেদ করে কার্যত দ্বিধা বিভক্ত করে ফেলে। এতে করে যশোর সেনাপতিদের মধ্যে ভাঙন ধরে এবং বিনষ্ট হয় বাহিনীর ঐক্য ও শৃঙ্খলা। এলোপাতাড়ি মুখোমুখি যুদ্ধে নৌ-অধ্যক্ষ খাজা কামাল নিহত হন। উদয়াদিত্য হতাশ হয়ে পড়েন এবং কোনরকমে বন্দিত্ব এড়িয়ে দ্রুত ধুমঘাটে পিতার নিকট পালিয়ে যান। জামাল খান সালকা দুর্গ ত্যাগ করে হাতীর বহরসহ উদয়াদিত্যের অনুসরণ করেন। প্রতাপাদিত্য কাগরঘাট খাল ও যমুনার সঙ্গমস্থলের নিকটে তাঁর নতুন ঘাঁটি থেকে দ্বিতীয়বার যুদ্ধের প্রস্ত্ততি নেন। তিনি যুদ্ধের জন্য সুবিধাজনক স্থানে একটি বৃহৎ দুর্গ নির্মাণ করান এবং সেখানে তাঁর সমুদয় সৈন্য মোতায়েন করেন। মুগল বাহিনী যশোর নৌবহরের উপর আক্রমণ চালিয়ে যুদ্ধের সূচনা করে (জানুয়ারি ১৬১২) এবং মুগলদের প্রবল আক্রমণের মুখে যশোর নৌবহর দুর্গের তলদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু যশোর গোলন্দাজদের কামানের ভারী গোলাবর্ষণে মুগল বাহিনীর অগ্রগতি ব্যাহত হয়। শেষ পর্যন্ত মুগলদের এক আকস্মিক আক্রমণে যশোর নৌবহর সম্পূর্ণ পরাজিত হয়। মুগল সৈন্যরা অগ্রভাগে হাতির বহর নিয়ে প্রতাপাদিত্যের দুর্গের উপর আক্রমণ চালায়। ফলে প্রতাপাদিত্য দুর্গ পরিত্যাগ করে পশ্চাদপসরণে বাধ্য হন।
দ্বিতীয়বারের পরাজয় স্তব্ধ করে দেয় প্রতাপাদিত্যের ভাগ্যের চাকা। তিনি কাগরঘাটায় গিয়াস খানের নিকট আত্মসমর্পণ করেন। গিয়াস খান কড়া পাহারায় প্রতাপাদিত্যকে সঙ্গে করে ঢাকায় ইসলাম খানের নিকট নিয়ে যান। যশোরের রাজাকে ঢাকায় বন্দী করে রাখা হয় এবং তাঁর রাজ্য মুগল সুবার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তাঁর পুত্রদেরও সম্ভবত ঢাকায় কারারুদ্ধ রাখা হয় এবং পরে দিল্লিতে পাঠানো হয়। প্রতাপাদিত্যের জীবনের শেষ দিনগুলো সম্পর্কে কোনো প্রামাণ্য তথ্য পাওয়া যায় নি। সম্ভবত বন্দি অবস্থায় দিল্লি যাওয়ার পথে বেনারসে তাঁর মৃত্যু হয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here