স্টাফ রিপের্টার : ভয়ঙ্কর জনপদ ভাতুড়িয়া নারায়নপুরের মাটি দাঁপিয়ে বেড়ানো নুরু বাহিনীর ক্যাডারদের প্রধান শক্তি অবৈধ অস্ত্র। এসব ক্যাডাররা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে অস্ত্রের ভাষায় কথা বলতে পারদর্শি। তারা প্রয়োজনে পাখির মতো মানুষ খুন করতেও সিদ্ধহস্ত। এই বাহিনীর ক্যাডাররা ধরা পড়ে, জেল খাটে। খুঁটির জোর থাকায় বেরিয়ে আবার হাঁটে পুরোনো রাস্থায়। জীবন জীবিকা চালাতে এসব ক্যাডাররা কৃষি কাজ ও মৎস্য চাষের পাশাপাশি অবৈধ মাদক ও অস্ত্রের কেনাবেচা করে বলেও অভিযোগ রয়েছে। সূত্র বলছে, বর্তমানে এই বাহিনীর নিয়ন্ত্রনে দেশি বিদেশী মিলে কমপক্ষে ৫০ থেকে ৬০টি ছোট বড় আগ্নেয়াস্ত্র আছে। নিজেদের প্রয়াজনে ব্যবহারের পাশাপাশি ক্যাডাররা এসব অস্ত্র ভাড়ায় ব্যবহার করে । আর এসব কিছুই নিয়ন্ত্রিত হয় বাহিনী প্রধান নুর ইসলাম ওরফে নুরু মহুরীর নির্দেশনায়। সম্প্রতি নুরু গংয়ের অতীত ও বর্তমান কর্মকান্ড নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে এসব ভয়ঙ্কর তথ্য। জেলা পুলিশের দাগী অপরাধী তালিকায়ও রয়েছে নুরু বাহিনীর একাধিক ক্যাডারের নাম।
ভয়ঙ্কর জনপদ ভাতুড়িয়া নারায়নপুর, চাঁচড়াসহ আশেপাশের দশ গ্রামে নুরুর কথায় শেষ কথা। তার কথার ওপর কথা বলার সাহস নেই কারোর। দৌরান্ত প্রতাপ শালী এই নুরুর জন্ম একটি হাভাতে ঘরে। কিন্তু কালের আবর্তে সে এখন কেটি কোটি টাকার স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির মালিক। নামে বেনামে তার দখলে রয়েছে কয়েকশ’ বিঘা জমি। এসব জমিতে সে কৃষি কাজের পাশাপাশি মাছের ঘের ও প্রিন্টিং ব্যবসা পরিচালনা করছে। বৈধ অবৈধ এসব ব্যবসার কাজে ছেলে ও মেয়ের জামাইয়ের পাশাপাশি তার ক্যাডার ও তাদের সন্তানদের কাজে লাগাচ্ছে নুরু। ফলে ক্যাডাররা নুরুর ব্যাপারে এক প্রকার অন্ধ। তার কথার ওপর কেউ কোন কথা বলে না। এই অঞ্চলের সকল অপকর্ম আর খুন খারাবীর নেপথ্য নায়ক এই নুরুর উত্থার আরব্য উপন্যাসের কাহিনীকেও হার মানায়। ১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসলে বেপরোয়া হয়ে ওঠে শহরের শংকরপুর কেন্দ্রীক হাসান সিন্ডিকেট। এসময় হাসান সিন্ডিকেট ছিল একটি অপ্রতিরোধ্য নাম। হাসান বাহিনীর অন্যতম ক্যাডার ভাতুড়িয়ার লিটু এসময় লাইম লাইটে। দলের মধ্যে লিটুর একটি শক্ত অবস্থান তৈরী হওয়ার পাশাপাশি তার চাচাত ভাই নুর ইসলাম ওরফে নুরু এই বাহিনীর শেল্টারে চলে যায়। কর্মদক্ষতা দিয়ে অল্প দিনে নুরু হাসান সিন্ডিকেটের ক্যাশিয়ারের পদ লাভ করে। টাকার থলেদ্দার হওয়ার সুবাদে এসময় নুর ইসলাম ওরফে নুরু এলাকার একজন হয়ে ওঠে। তার কথার বাইরে কেউ গেলে তাকে শায়েস্তা করা হতো ক্যাডার দিয়ে। প্রথমে হুমকি। না হলে ধামকি। আর একেবারে না হলে হয় গোরস্থান না হয় শশ্মান হয়ে ওঠে প্রতিবাদকারীদের ঠিকানা। আর নুর ইসলাম ওরফে নুরুর ক্যাডারদের এসব কর্মকান্ডের দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে হাসান সিন্ডিকেটের চীফ হাসান ও তার সহোদর মিজান এবং মশিউল লিটু ও নুর ইসলামের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল হয়ে ওঠে। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নুর ইসলাম ওরফে নুরু একটি সরকারী দপ্তরে পিয়নের চাকুরি জুটিয়ে নেয়। সেটাও ছিল তার সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে টিকে থাকার একটি নব্য কৌশল। দিনের বেলায় সরকারী অফিস করলেও রাতের বেলা সে তার বাহিনী পরিচালনা করে গোটা এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। আর এসব কর্মকান্ডের মাধ্যমে একদিকে যেমন হাসান বাহিনীকে প্রতিষ্ঠিত করেছে অন্যদিকে নিজেও হয়েছেন প্রতিষ্ঠিত। এভাবে নুর ইসলাম ওরফে নুরু মহুরী রাতারাতি বনে গেছেন কোটিপতি। এক পর্যায়ে সে অর্থ ও অস্ত্রের জোরে গোটা এলাকায় রামরাজত্ব কায়েম করে। এদিকে ১/১১ সরকারের আমলে পরিস্থিতি প্রতিকুল হওয়ায় হাসান বাহিনীর বিশাল অস্ত্র ভান্ডার লিটু ও নুরু গংয়ের হেফাজতে রেখে হাসান, মিজান, মশিউলসহ তার বহু ডাকসাইডের ক্যাডার গা ঢাকা দেয়। অনেকেই চলে যায় আন্ডারগ্রাউন্ডে। এক পর্যায়ে ঢাকার মিরপুর থেকে র্যার সদস্যরা হাসান ও মিজানকে আটক করে। অস্ত্র উদ্ধারের নামে তাদেরকে ঢাকা থেকে ভাতুড়িয়ায় নিয়ে যায় র্যাব। এখানে লিটু বাহিনীর ক্যাডারদের সাথে র্যাবের ক্রস ফায়ারে নিহত হয় দুই সহোদর হাসান ও মিজান। এসময় র্যাব সদস্যরা ২টি নাইন এমএম পিস্তল, দুটি দেশি তৈরী রিভলবার, ২টি চাইনিজ রাইফেলসহ বেশ কিছু দেশী তৈরী অস্ত্র উদ্ধার করলেও হাসান সিন্ডিকেটের মুল অস্ত্র ভান্ডার থেকে যায় অক্ষত। এক পর্যায়ে লিটু তার প্রধান দেহরক্ষী ভাতুড়িয়ার কালা মিন্টু ও কসাই মান্নানকে সাথে নিয়ে ভারতে পালিয়ে যায়। সে সময় লিটু তার হেফাজতে থাকা হাসান সিন্ডিকেটের যাবতীয় অস্ত্র ও গোলাবারুদ নুরু মহুরীর হেফাজতে রেখে যায় বলে পরবর্তীতে পুলিশ বাহিনীর একটি গোপন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এক পর্যায়ে ১/১১ সরকারের সময় এই অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ বাহিনীর সদস্যরা নুর ইসলাম নুরুসহ তার ক্যাডার জাহাঙ্গীর,রওশন, রফিকুল, মামুন, মকলেসসহ বেশ কয়েকজন ক্যাডারকে আটক করে। পরে তাদেরকে জিঙ্গাসাবাদের জন্য যশোর কোতয়ালী পুলিশের হাতে সোপর্দ করে বিশেষ বাহিনীর সদস্যরা। কিন্তু রহস্যজনক কারনে সে সময় পুলিশ এসব ক্যাডার ও তাদের গড ফাদার নুরুকে জিঙ্গাবাদের নামে কালক্ষেপন করে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে প্রেরণ করে। অস্ত্র উদ্ধারের উদ্যোগ ভেস্তে যায়। জেল বিদ্রোহের সময়ও যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে নুরুর ক্যাডাররা ব্যাপক হট্টগোল করে। অংশ নেয় কারা অভ্যান্তরে খুন খারাবীতে। পরবর্তীতে ধারাবাহিক ভাবে নুরুসহ তার ক্যাডাররা একে একে বের হয়ে আসে কারাগার থেকে। বর্তমান সরকারী দল ক্ষমতায় আসলে নুরু ও তার ক্যাডাররা নিজেদের অবস্থা পাল্টে সরকারী দলের স্থানীয় নেতাদের আশ্রয় প্রশয়ে ফের সক্রিয় হয়ে ওঠে। শুরু করে অপারেশন নুরু এ্যাটাক। এর পর নুরু বাহিনীর ক্যাডাররা অনেকটা অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। ভারতে আশ্রয় নেয়া লিটু তার প্রধান দেহরক্ষী কালা মিন্টু ও কসাই মান্নানের হাতে নিহত হয়। এক পর্যায়ে তারা দুই জন লিটুর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে দেশে ফিরে নুরু মহুরীর সাথে হাত মেলায়। এসময় নুরু তাদেরকে তার বাহিনীর চীফ কমান্ডার অব অপারেশনের দায়িত্ব দিয়ে নিজে অন্তরালে চলে যান। তবে বাহিনীর সকল কর্মকান্ডে দাদাগিরি করেন নুরু মহুরী। এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে যশোর পুলিশের গোয়েন্দা নথিতে নুর ইসলাম, কালা মিন্টু, কসাই মান্নান, আশরাফ, জাাঙ্গীর, মামুন, বোমা আজাদ,কামরুল, ইউনুস, আলম,শামিম, সেলিম,মোস্তফা, আতি খোকা, রাজু, ইকরামুল কে টপ টেরর হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এসব টেররদের হাতে নাইন এম এম পিস্তল, চাইনীজ রাইফেল, কাটা রাইফেল,দেশি তৈরী বন্দুক, হাতে তৈরী পিস্তল, দেশি বিদেশী রিভলবারসহ দেশি বিদেশী প্রায় শতাধিক অস্ত্র রয়েছে। যা উদ্ধারে পুলিশের কম্বিং অপারেশ প্রয়োজন বলে ওই গোপন প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল। কিন্তু অদ্যাবধি সেই গোপন নির্দেশনা জেলা পুলিশ বা কোতয়ালী পুলিশ আজও বাস্তবায়ন না করায় নুরু বাহিনীর অস্ত্রভান্ডার এখন অক্ষত বলে দাবি করছেন স্থানীয় একাধিক মহল। তাদের বক্তব্য হচ্ছে অবিলম্বে এই নুরু বাহিনীর ক্যাডারদের আটক ও তাদের নিয়ন্ত্রিত অস্ত্র উদ্ধারে পুলিশ ও র্যাবের একটি জয়েন্ট অপারেশন প্রয়োজন। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে যশোর কোতয়ালী মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মনিরুজ্জামান বলেন, ওই প্রতিবেদনের বিষয়টি তার অজানা। তবে সম্প্রতি বিভিন্ন ঘটনায় নুরু ও তার ক্যাডারদের নিয়ে অনেক তথ্য বেরিয়ে আসছে। পুলিশ এসব বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখছে। সুযোগ মতো পুলিশ তার কর্মকান্ড পরিচালনা করবে। তবে এই থানায় কোন ক্যাডার বাহিনী বা কাউকে গডফাদারের ভুমিকায় অবতীর্ণ হতে দেওয়া হবে না। যে যতই শক্তিশালী হোক তাদেরকে আইনের আওতায় আনতে পুলিশ বদ্ধপরিকর। আর এসব অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান অব্যাহত আছে। প্রয়োজনে তা আরো জোরদার করে কম্বিং অপারেশ চালানো হবে বলেও তিনি আশ^স্ত করেন।