নিজস্ব প্রতিবেদক : বেদব্যাস রচিত বিষ্ণু পুরানে বলা হয়েছে, কৃষ্ণের পৃথিবী ত্যাগ করে স্বর্গারোহন সময় থেকে পৃথিবীতে কলিযুগের সূচনা হয়েছে। মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের পূর্ণিমা তিথিতে শুক্রবারে কলিযুগের উৎপত্তি। খ্রীষ্টপূর্ব ৩১০১ অব্দে কলিযুগের সূচনা হয়। বর্তমানে কলিযুগের ৫১২১ বছর চলছে।
অভিমূন্যের ছেলে পরীক্ষিৎ হল দ্বাপর আর কলির সন্ধিক্ষনের রাজা। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের অবসানে জন্ম হয় পরীক্ষিতের। যথা সময়ে তাঁর হাতে রাজ্যপাট দিয়ে মহাপ্রস্থানের পথে যান পাণ্ডবরা। মহারাজ পরীক্ষিতের রাজত্বকালের মধ্যে কলিযুগ শুরু হয়েছে।
মহারাজ পরীক্ষিৎ একদিন মৃগয়া করতে অরণ্যে গেলেন। একসময় মহারাজ পরীক্ষিৎ জঙ্গলে ভ্রমণকালে দেখতে পেলেন, কালো চেহারার একটি লোক একটি বলদকে খুব প্রহার করছে। কিন্তু বলদটি বসা থেকে কোনমতেই উঠতে পারছে না। কারন বলদটির তিনটি পা নেই।
ধার্মিক রাজা অত্যাচার দেখে, তৎক্ষণাৎ তরবারি বের করে লোকটিকে হত্যা করতে উদ্যত হলে, লোকটি নতজানু হয়ে রাজার কাছে প্রাণভিক্ষা করে।
মহারাজ পরীক্ষিৎ তখন লোকটিকে জিজ্ঞাসা করেন – তুমি কে, এবং কেন এইভাবে প্রহার করছ ?
লোকটি করজোড় করে উত্তর দেয় – প্রভু আমি হলাম কলিযুগ। দ্বাপর শেষ হয়ে আমার আগমন ঘটেছে।
তখন মহারাজ পরীক্ষিৎ কলিকে(কলিযুগ) বললেন – তুমি যখন করজোড় করে শরণাগত হয়েছ, তখন তোমার কোন ভয় নেই, আমি তোমাকে প্রাণে মারবো না। কিন্তু তুমি অধর্মের পরম বন্ধু, এই জন্য তোমার এই ব্রহ্মবর্তে থাকার কোন অধিকার নাই কারণ এই জায়গা ধর্ম ও সত্যের বাসস্থান।
মহারাজ পরীক্ষিতের এই কথা শুনে কলি(কলিযুগ) বলল – প্রভু, সমস্ত পৃথিবীই আপনার রাজত্ব, আপনি আমাকে এমন স্থান নির্দেশ করুন যেখানে আপনার আদেশ পালন করে নির্ভয়ে থাকতে পারি।
মহারাজ পরীক্ষিৎ বুঝলেন কলিকে ঈশ্বর পাঠিয়েছেন। কলির প্রার্থনা পূরণ করে মহারাজ পরীক্ষিৎ কলিকে চারটি স্থানে আশ্রয় দিলেন। যথা – ১.জুয়া, ২.নেশা, ৩.বেশ্যা গৃহে, ৪.হিংসা(জীব হত্যা)তে, এইসবে যথাক্রমে অসত্য, মদ, আসক্তি ও নির্দয়তা – এই চার রকমের অধর্ম বাস করে।
কলি এইসব স্থান পেয়ে কলি তৃপ্ত না হয়ে আর একটু স্থান চাইল। মহারাজ পরীক্ষিৎ তখন কলির বাসের জন্য আরও একটি অবলম্বন ৫.সোনা(ধন) দিলেন। যেখানে রজোগুণের উৎপত্তি।
রাজার আদেশ অনুসারে কলিযুগ এই ৫টি স্থানে বাস করতে রাজাকে প্রণাম করে যথা আজ্ঞা প্রভু বলে চলে গেলেন।মহারাজ পরীক্ষিৎ চিন্তিত মনে প্রাসাদে ফিরে এলেন। পরের দিন মৃগয়া করতে যাওয়ার আগে, তার পূর্বপুরুষদের দ্বারা সঞ্চিত ধন-সম্পদের ঘরে গেলেন। সেখানে একটি স্বর্ণমুকুট পছন্দ হল, সেটি তিনি পড়লেন। স্বর্ণমুকুটটি ভীম, জরাসন্ধকে হত্যা করে নিয়ে এসেছিল। অর্থাৎ অন্যায় পথে উপার্জিত ধন। কলি ইতিমধ্যেই প্রবেশ করেছেন স্বর্ণমুকুটে। পরীক্ষিৎ তো কলিযুগকে এমন স্থান দিয়েছেন ! সুতরাং তাঁর উপরেও কলি প্রভাব শুরু করল।মৃগয়া করতে গিয়ে পরীক্ষিৎ এক মৃগকে বাণবিদ্ধ করে তার অনুসরণ করতে করতে শমীক ঋষির আশ্রমে উপস্থিত হন। শমীক ঋষিকে মৃগ সম্পর্কে প্রশ্ন করেন। কিন্তু শমীক ঋষি তাঁর কথা শুনতে পান না, কারন তিনি সমাধিতে ছিলেন। পরীক্ষিৎ মনে করলেন ঋষি তাঁকে অবহেলা করে শুনছে না। তৃষ্ণার্ত ও পরিশ্রান্ত পরীক্ষিৎ কলির প্রভাবে মেজাজ হারালেন। তাই তিনি ক্রোধের বশে, সামনে পড়ে থাকা একটি মৃত সাপ ঝুলিয়ে দিলেন ঋষির গলায়। এরপর বেরিয়ে গেলেন সেখান থেকে। শাস্ত্র মতে এই দিন থেকেই দ্বাপর যুগের অবসান এবং কলিযুগের সূচনা হয় l
প্রাসাদে ফিরে মুকুট খোলার সাথে সাথে কলির প্রভাব সরে গেল, তিনি নিজের ভুলের কথা স্মরণ করে অনুতপ্ত হতে লাগলেন।শমীক ঋষির পুত্র শৃঙ্গী আচার্যের গৃহ থেকে ফেরার সময় কৃশ নামে এক বন্ধুর কাছে জানতে পারেন যে কেউ তাঁর পিতাকে অপমান করেছেন। তখন শমীক ঋষির পুত্র শৃঙ্গী অভিশাপ দেন যে তাঁর নিরপরাধ পিতাকে অপমান করেছেন সপ্তরাত্রির মধ্যে তক্ষক নাগের দংশণে তার মৃত্যু হবে।
ঋষি-পিতা সমাধি থেকে উঠলে, তাঁকেও ঋষিপুত্র সব জানায়। শমীক ঋষি তখন ধ্যানমগ্ন হয়ে দেখলেন – সেই ব্যক্তি রাজা পরীক্ষিৎ। নিজ পুত্রকে বোঝান, পুত্র অনেক বড় ভুল করে ফেলেছ। এক রাজর্ষিকে অভিশাপ দিয়েছ। অভিশাপ তো বিফলে যাওয়ার নয়, তাই শমীক ঋষি শিষ্য গৌরমুখকে পাঠিয়ে পরীক্ষিৎকে খবর পাঠালেন – মৃত্যুর জন্য যোগ্য প্রস্তুতি নিতে।মহারাজ পরীক্ষিৎও জানতে পারলেন অভিশাপের কথা। শমীক ঋষির শিষ্য গৌরমুখের কাছ থেকে ঋষিপুত্রের শাপ সম্পর্কে জানতে পেরে পরীক্ষিৎ অত্যন্ত দুঃখিত হন। তিনি মন্ত্রীদের সাথে মন্ত্রণা করে একটিমাত্র স্তম্ভের ওপর সুরক্ষিত প্রাসাদ নির্মাণ করেন এবং বিষচিকিৎসক ও মন্ত্রসিদ্ধ ব্রাহ্মণদের নিয়োগ করেন। রাজকার্য উপলক্ষে একমাত্র মন্ত্রীগণই তার কাছে যেতে পারতেন।
সপ্তম দিনে কাশ্যপ নামক বিষচিকিৎসক রাজার কাছে যাওয়ার পথে তক্ষক নাগ ব্রাহ্মণের বেশে তাঁর কাছে উপস্থিত হন এবং অর্থের পরিবর্তে তাঁকে ফিরে যেতে বলেন। কাশ্যপ যোগবলে রাজার আয়ু শেষ হয়েছে জেনে অভীষ্ট ধন নিয়ে ফিরে যান। এরপর তক্ষকের উপদেশে তার কয়েকজন অনুচর ব্রাহ্মণের বেশে পরীক্ষিতের কাছে এসে ফল, কুশ ও জল দিয়ে বিদায় নেয়। তিনি অমাত্যগণের সঙ্গে ফল খেতে গিয়ে দেখেন ফলের ভিতর ক্ষুদ্র কৃষ্ণনয়ন তাম্রবর্ণ কীট। রাজা বুঝতে পারেন তাঁর মৃত্যুকাল আসন্ন। তাই তিনি কীটটিকে স্বেচ্ছায় গলার ভিতর রেখে হাসতে থাকেন। তখন তক্ষক নাগ নিজ রূপ ধারণ করে সগর্জনে পরিক্ষীতের মস্তকে দংশন করেন। ৪ বছর রাজ্য শাসনের পরে মৃত্যু হল ৬০ বছর বয়সী পরীক্ষিতের।
পরীক্ষিৎ পুত্র জনমেয়জয় সিংহাসনে বসিয়া পিতা পরীক্ষিতের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য সর্পকুলকে চিরতরে ধ্বংস করার জন্য আরম্ভ করল সর্প যজ্ঞ। কিন্তু আস্তিক