মালেকুজ্জামান কাকা, যশোর : এক যে ছিল রাজা তার রাজ্য ছিল বাংলাহাতি শালে হাতি ছিল ঘোড়া শালে ঘোড়াকলের নাঙল আঙিনায় করে যেই বসালো ডেরা নাঙল-যোয়াল-বিঁদে ছাড়লো বটে মনের দুখে গাঁ।বৃহৎ যশোরের এমন কোন গ্রাম ছিলনা যেই গ্রামে বলদ আর নাঙল ছিল না। পরিবার প্রতিই তা ছিল যুগ যুগ ধরে কৃষি ঐতিহ্যের ধারক হয়ে। যশোর শহরেও ভোরে গরুর গাড়িতে বিভিন্ন মালামাল বাজারের মোকামে আনা হোত। কিন্ত যান্ত্রিক আগ্রাসনে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে গরুর হাল। অথার্ৎ নাঙল-জোয়াল। নাঙল হচ্ছে কাঠের ও তালের কাঠের ইশযুক্ত উপকরণ যা কৃষক ধরে রাখতো হাতে। ফলা বিধেঁ থাকতো মাটিতে। আর নাঙলের ভারসাম্য বজায়ে রাখার জন্য দড়িযুক্ত যোয়াল দুই গরুর কাধেঁ রাখা হোত। এক হাতে নাঙল আর অন্য হাতে পাঁচন। হ্যা গরু শাষনের লাঠিকে চাষী বলে পাঁচন। গরু হাটতে শুরু করলেই নাঙলের ইশ বিঁেধ যেত মাটিতে। জমির চাষাবাদ শুরু হয়ে যেত। জমি চাষের কাজে কৃষক কিছুদিন আগেও কাঠের তালের তৈরি নাঙল, জোয়াল, মই ও হালের বলদ ব্যবহার করতো। চাষাবাদের এসব কৃষি উপকরণ মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে ব্যবহার করে এসেছে। ছিল তার মধুর ঐতিহ্য। কিন্তু কালের বিবর্তনে এসবের ব্যবহার আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। পরিবেশবান্ধব লাঙল-জোয়ালের জায়গা দখল করে নিয়েছে যান্ত্রিক পাওয়ার টিলার আর ট্রাক্টর। আগে লাঙল ছাড়া চাষাবাদের কথা চিন্তা করা যেত না। কিন্তু আধুনিক যুগে চাষাবাদের জন্য ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলারের মতো যান্ত্রিক সব উপকরণ আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব আধুনিক যন্ত্রের সাহায্যে চাষাবাদে আগের তুলনায় সময়, শ্রম ও অর্থের সাশ্রয় হচ্ছে। ফলে কৃষক আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করে চাষাবাদ করছে। এতে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী লাঙল, জোয়াল, মই ও হালের বলদ। বর্তমানে গ্রামবাংলার প্রায় সব কৃষক জমি চাষের জন্য ট্রাক্টর ব্যবহার করেন।
ব্যাপক চাহিদা থাকায় কেউ কেউ যন্ত্রটি ভাড়া দিয়ে ব্যবসাও করছেন। লাঙল-মইসহ কৃষি সরঞ্জাম তৈরি করা যাদের পেশা তারা এখন বেশিরভাগ সময় বেকার বসে থাকছেন। ফলে অনেকেই এই পেশা ছেড়ে নতুন পেশায় চলে যাওয়ার কথা ভাবছেন। এভাবে হয়তো একদিন লাঙল তৈরির পেশায় থাকা ব্যক্তিরা তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে এই কাজ আর শেখাবে না। নতুন পেশা খুঁজে নেবেন তারা। তখন হাজার বছরের লাঙল-জোয়ালের স্থান হবে জাদুঘরে। মানুষের সভ্যতার ইতিহাসের সাী হয়ে থাকবে এই লাঙল-জোয়াল। মনিরামপুর মধুপুরের কৃষক আব্দুর রশিদ বলেন, একসময় নাঙল, জোয়াল, মই ও বলদ ছাড়া চাষাবাদ কল্পনা করা যেত না। কিন্তু যান্ত্রিকতার জোয়ারে এই যুগে সব হারিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া আগের মতো লাঙল দিয়ে চাষাবাদও করছে না মানুষ।
চৌগাছা উপজেলার কৃষক বকুল হোসেন জানান, বাজারে হালের বলদের দাম চড়া। পোষার ঝামেলা এসব নানা কারণে এই এলাকার কৃষক নাঙল-জোয়ালের ব্যবহার কমিয়ে দিয়েছে। শার্শা উপজেলার নাভারনের কৃষক সাহাবুদ্দিন বলেন, এলাকার কিছু কিছু গৃহস্থের ঘরে আজও নাঙল-জোয়াল ও হালের বলদ আছে। কারণ যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ হওয়ায় গৃহস্থের সব জমিতে পাওয়ার টিলার বা ট্রাক্টর নেয়া সম্ভব হয় না। সেইসব জমিতে মান্ধাতার আমলের নাঙল দিয়ে হালচাষ করতে হয়।
কৃষিবিদদের মতে, নাঙল-জোয়াল বলদের কাঁধে বসিয়ে হালচাষ পদ্ধতি পরিবেশবান্ধব। কারণ গরুর গোবর থেকে নির্ভেজাল জৈবসার পাওয়া যায়। এই সার জমির উর্বরা শক্তি ও পুষ্টিগুণ বৃদ্ধি করে। তাই এই পদ্ধতি কৃষকের জন্য লাভজনক ও পরিবেশ সহায়ক। তবে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে হালচাষে সময় গরুর নাঙলের তুলনায় কম লাগে। এছাড়া অতিরিক্ত জনবলের প্রয়োজন হয় না। এ পদ্ধতির হালচাষে কৃষক নিজেদের অনেকটাই ঝামেলামুক্ত মনে করেন।