রুদ্র মিজান ঃ অবৈধ হাসপাতাল ও ডায়াগনষ্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে অভিযান। একের পর এক সিলগালা করে দেওয়া হচ্ছে অবৈধ সব প্রতিষ্ঠান। চিকিৎসার নামে যে সব প্রতিষ্ঠান মানুষের স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে ব্যবসা করছে তাদের দুর্দিন শুরু হচ্ছে। স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে এই অভিযান চলবে। এই সেক্টরকে কলুষ মুক্ত করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে নির্দেশনা দিয়েছেন তা বাস্তবায়নে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রনালয়। ইতিমধ্যে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় যে সব বেসরকারী হাসপাতাল ও কিনিক এবং ডায়াগনষ্টিক সেন্টার খুলে মালিকরা ব্যবসা পেতে বসেছেন তাদের সম্পর্কে খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্ত চেয়ে ইতিমধ্যে জেলার সিভিল সার্জনের অফিস থেকে পত্র ইস্যু করা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষে সিভিল সার্জনের ইস্যুকৃত পত্রটি ইতিমধ্যে হাতে পেয়েছেন বাংলাদেশ প্রাইভেট হাসপাতাল ও কিনিক এবং ডায়াগনষ্টিক ওনার্স এসোসিয়েশন যশোর জেলার সাধারণ সম্পাদক জয়ন্ত কুমার বিশ^াস। গত ১৯ জুলাই সিএসজে/এস-১/২০২০৪৩০০/ (৮/৪০) নম্বর স্মারকে ইস্যুকৃত ওই পত্রে প্রতিষ্ঠান সম্পর্কীত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য চাওয়া হয়েছে। ওই তথ্যের ভিত্তিতেই জেলার সব অবৈধ কিনিক ও ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে ধারাবহিক অভিযন পরিচালনা করছে জেলার স্বাস্থ্য বিভাগ।
যশোরের সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা গেছে, যশোর জেলায় ১০৬টি বেসরকারী কিনিক ও ১৫৬টি ডায়াগনষ্টিক সেন্টার আছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত এমন অনেক প্রতিষ্ঠান যৌথ ভাবে কিনিক ও ডায়াগনষ্টি সেন্টার পরিচালনা করছে। আবার বহু প্রতিষ্ঠান আছে যারা কেবল মাত্র ডায়াগনষ্টিক সেন্টারের লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা করছে। ফলে এই দুই ধরনের প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে জেলায় মোট ২৬২ টি বেসরকারী হাসপাতাল, কিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বিদ্যমান। এরমধ্যে যশোর সদরে ৬২, অভয়নগরে ১৪, বাঘারপাড়ায় ৭, চৌগাছায় ৮, ঝিকরগাছায় ৯, কেশবপুরে ১২, মণিরামপুরে ১০ ও শার্শায় ১২টি কিনিক ও ডায়াগনষ্টিক সেন্টার রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২১১ টি প্রতিষ্ঠানকে ইতিমধ্যে জেলার স্বাস্থ্য বিভাগ অবৈধ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এরমধ্যে ১০৫ টির কোন বৈধ লাইসেন্স নেই। এসব প্রতিষ্ঠান কর্তৃপ অনলাইনে আবেদন করেই কার্যক্রম শুরু করেছে। আর ১০৬ টির লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হলেও গত ২ বছর ধরে তারা নবায়ন না করে ব্যবসা পরিচালনা করছেন।যা অঅইনের চোখে অবৈধ। এছাড়া হালনাগাদ লাইসেন্স রয়েছে জেলায় এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৫১ টি।
জেলার ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. আবু মাউদ জানিয়েছেন, গত ১৪ জুলাই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা মোতাবেক তারা জেলার বেসরকারী হাসপাতাল, কিনিক ও ডায়াগনষ্টিক ওনার্স এসোসিয়েশন কর্তৃপক্ষকে গত ১৯ জুলাই ৩দিনের সময় দিয়ে একটি পত্র প্রেরণ করেছিলেন। ওই পত্রের আলোকে মালিক কর্তৃপক্ষ যে তথ্য সরবরাহ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে ৫১টি প্রতিষ্ঠান বাদে বাকি গুলোর লাইসেন্সের মেয়াদ গত ২ বছর আগেই শেষ হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে অনেকে অন লাইনে ফি জমা দিয়ে আবেদন করেছেন। কিন্তু উক্ত আবেদন ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় তাদের লাইসেন্স কর্তৃপক্ষ নবায়ন করেনি। এছাড়া বহু প্রতিষ্ঠান ব্যবসা শুরু করার আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে লঅইসেন্সের জন্য আবেদনপত্র জমা দিয়েছেন। কিন্তু লাইসেন্স পাওয়ার আগেই তারা ব্যবসা শুরু করে দিয়েছেন। এসব অবৈধ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ট্যাক্সফোর্সের অভিযান শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে জেলার ৮টি অবৈধ কিনিক ও ডায়াগনষ্টিক সেন্টার বন্ধ ঘোষনা করে সিলগালা করা হয়েছে। আটক করা হয়েছে এসব প্রতিষ্ঠানের মালিক ও ভুয়া ডাক্তার আর হাতুড়ে টেকনিশিয়ানদের। এর মধ্যে গত সোমবার যশোর শহরের ঘোপ সেন্ট্রাল রোডের সততা ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও আধুনিক হাসপাতালের ডায়াগনস্টিক কার্যক্রম, মণিরামপুর উপজেলার মুন হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার (হাসপাতাল মোড় শাখা), নিউ প্রগতি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার, নিউ লাইফ ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও মুন হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার কুয়াদা শাখায় অভিযান চালিয়ে ট্যাক্স ফোর্স সিলগালা ও জরিমানা করেছে। এর আগে গত ২৬ জুলাই রোববার খাজুরার মাতৃভাষা কিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ২১ জুলাই বুধবার বসুন্দিয়ার মহুয়া কিনিক এন্ড ডায়াগনষ্টিক সেন্টারটি সিলগালা করা হয়। আটক করা হয় এই কিনিকের মালিক ভুয়া ডাক্তারকে। তাকে ১ লাখ টাকা জরিমান ও ১ বছরের সশ্রম কারাদন্ডাদেশ প্রদান করে ভ্রাম্যমান আদালত। আধুনিক হাসপাতাল ছাড়া অন্য প্রতিষ্ঠান গুলোতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, সেবিকা ও টেকলজিষ্ট নেই। অবৈধভাবে এসব প্রতিষ্ঠানে অপচিকিৎসা চলছিলো বলে জানান ডাক্তার আবু মাউদ।
ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. আবু মাউদ আরো জানান, জেলায় মোট ২৬২ টি বেসরকারী হাসপাতাল, কিনিক ও ডায়াগনষ্টিক সেন্টারের মধ্যে যশোর শহর ও সদর উপজেলায় রয়েছে ৬৮টি। যার অর্ধেকের বেশি বর্তমান সময়ে অবৈধভাবে চলছে। তারা এখানো হালনাগাদ লাইসেন্স পাননি। এছাড়া ৭ টি নতুন প্রতিষ্ঠানের মালিক কর্তৃপক্ষ লাইসেন্সের জন্য অনলাইনে আবেদন করে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। যা সম্পূর্ণ অবৈধ। এর চেয়ে ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছে বিভিন্ন উপজেলায় অবিস্থত হাসপাতাল কিনিক ও ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে। সরকারের অনুমোদন নিয়ে বা নানিয়ে খুলে বসা এসব প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসার নামে চলছে ব্যবসা। তাদের ফাঁদে পড়ে অনেক রোগীই নানা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। সাইনবোর্ড সর্বস্ব এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়মনীতির বালাই নেই, হাতুড়ে টেকনিশিয়ান দিয়েই চালানো হচ্ছে রোগ নির্ণয়ের যাবতীয় পরীা এবং দেয়া হচ্ছে মনগড়া রিপোর্ট। অপারেশনের জন্য ভাড়া করে আনা হয় চিকিৎসক। অবৈধ হাসপাতাল কিনিক ও ডায়াগনষ্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে তিনি জানান। এক প্রশ্নের উত্তরে ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন বলেন, বহু প্রতিষ্ঠানের মালিক কর্তৃপক্ষ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালকের কাছে লাইসেন্সের জন্য অনলাইনে আবেদন করেছেন। কিন্তু এসব আবেদন ত্রুটিপূর্ণ। যে কারণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ওই প্রতিষ্ঠানগুলো পরিদর্শনের জন্য আজ পর্যন্ত কোনো চিঠি আসেনি। সরকারি অনুমোদনের তোয়াক্কা না করেই কর্তৃপক্ষ হাসপাতাল কিনিক ও ডায়াগনষ্টিক সেন্টার খুলে ব্যবসা শুরু করে দিয়েছে। বৈধ লাইসেন্স ও উপযুক্ত সময়ে নবায়নকৃত লাইসেন্স না থাকলে কোনো প্রতিষ্ঠানকে কার্যক্রম পরিচালনা করতে দেয়া হবে না। ২০১৭ সাল পর্যন্ত যাবতীয় রাজস্ব পরিশোধ করে যেসব হাসপাতাল ও কিনিক এবং ডায়াগনষ্টিক সেন্টারের যথাযথ অনুমোদন হালনাগাদ আছে কেবলমাত্র সেই সব প্রতিষ্ঠান কে কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য আপাতত সুযোগ দেয়া হচ্ছে । এমন প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে গিয়ে মালিক পকে লাইসেন্স নবায়ন দ্রুত সম্পন্ন করার জন্য সময় বেধে দেয়া হচ্ছে। নির্ধারিত সময়ে লাইসেন্স করতে বা লাইসেন্স নবায়ন করতে ব্যর্থ হলে ওই সব প্রতিষ্ঠানগুলো অবৈধ ঘোষণা করে বন্ধ করে দেয়া হবে।
ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন আরো বলেন, মণিরামপুরে মুন হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনষ্টিক সেন্টারের দুটি শাখা ছিলো। এখানকার মালিক আব্দুল হাই ডাক্তারী পেশায় পড়াশুনা না করেই নিজেকে চিকিৎসক পরিচয়ে রোগীর চিকিৎসাসেবা, অস্ত্রোপচারে অংশ নেয়াসহ সকল কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিলেন। অবৈধ কিনিক ও ডায়াগনষ্টিক সেন্টার খুলে সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে খেলছিলেন তিনি। বিষয়টি জানতে পেরে মুন হাসপাতালে অভিযান পরিচালনা করা হয়। এসময় সেখানে বিভিন্ন অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা চোখে পড়ায় দুটি শাখা সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে। ভুয়া চিকিৎসক আব্দুল হাইয়ের প্রতারণার বিষয়ে জেলা প্রশাসনকে অবগত করা হয়েছে।
ডা. আবু মাউদ আরো জানান, অবৈধ প্রতিষ্ঠান কোন ভাবেই পরিচালনা করার সুযোগ দেয়া হবে না। পর্যায়ক্রমে সবগুলোর কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হবে। ২০১৮ সাল থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর লাইসেন্স নবায়নের প্রক্রিয়াটি ডিজিটালাইজড করার কার্যক্রম শুরু করলেও ভুইফোঁড় প্রতিষ্ঠান মালিকদের কোন কর্ণপাত নেই বলে তিনি অভিযোগ করেন।
এসব বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে জেলার বেসরকারী হাসপাতাল কিনিক ও ডায়াগনষ্টিক ওনার্স এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও দড়াটানা হসপিটাল এন্ড ডায়াগনষ্টিক সেন্টারের ব্যবস্থাপক জয়ন্ত কুমার বিশ^াস বলেন, বর্তমানে জেলায় লাইসেন্স হালনাগাদ নবায়নসহ সকল ধরনের বৈধ কাগজপত্রের কথা যদি বলেন তাহলে মুষ্টিমেয় কিছু প্রতিষ্ঠান ছাড়া আইনের চোখে প্রায় সব প্রতিষ্ঠান অবৈধ। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের ২০১৭-১৮ অর্থ বছরের পর লাইসেন্স নবায়ন করা নেই। কারন হিসেবে তিনি বলছেন, আগে একটি ডায়াগনষ্টিক সেন্টারের লাইসেন্স নবায়ন ফি ছিল বাৎসরিক ১০০০ টাকা ও কিনিক বা হাসপাতালের লাইসেন্স নবায়ন ফি ছিল ৫০০০ টাকা। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মরহুম নাসিম সাহেবের আমলে এক লাফে তা বৃদ্ধি করে ডায়াগনষ্টিক সেন্টারের লাইসেন্স নবায়ন ফি বাৎসরিক ২৫,০০০ টাকা ও কিনিক বা হাসপাতালের লাইসেন্স নবায়ন ফি ১ থেকে ৪০ বেড পর্যন্ত ৪০,০০০ টাকা নির্ধারন করা হয়। যার প্রতিবাদে আমরা মালিক কতৃপক্ষ ফি কমানোর দাবিতে আবেদন করি। কিন্তু সে আবেদন অগ্রাহ্য করে আমাদের ফি জমাদানের সময় বাড়ানো হয়। যার কারনে গত ১৮-১৯ ও ১৯-২০ অর্থ বছরে যশোর জেলার অধিকাংশ বৈধ লাইসেন্স প্রাপ্ত কিনিক ডায়াগনষ্টিক সেন্টার গুলো তাদের লাইসেন্স নবায়ন করতে পারেনি। অনেকে অন লাইনে নবায়নের জন্য আবেদন করেছেন। কিন্তু অদ্যাবধি সে সব প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনসহ অন্যন্য কার্যক্রম শেষ না হওয়ায় লাইসেন্স নবায়ন ঝুলে রয়েছে। ফলে এসব বৈধ প্রতিষ্ঠান এখন আইনের মারপ্যচে অবৈধ হয়ে যাচ্ছে। তবে যে সব প্রতিষ্ঠান সরকারী নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে কেবল মাত্র ব্যবসা করার জন্য মানুষের রক্ত চুষে নিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের এই জিরো টলারেন্স নীতিকে স্বাগত জানান।