স্টাফ রিপোর্টার : বেনাপোল কাস্টম হাউজে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে পণ্য আমদানির সঙ্গে জড়িত মেসার্স শামসুর রহমানসহ ১০ সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহনের সুপারিশ করেছে এনবিআরের গঠিত তদন্ত কমিটি। গত বুধ ও বৃহস্পতিবার তদন্ত শেষ করেন তিন সদস্যের কমিটি; যার নেতৃত্বে ছিলেন মোংলা কাস্টমসের কমিশনার হোসেন আহমদ। এ সময় সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ীরা তাদের বিরুদ্ধে আনা শুল্ক ফাঁকির অভিযোগ মিথ্যা দাবি করে লিখিত পত্র জমা দিয়েছেন কমিটির কাছে। চলতি বছরের জানুয়ারির শুরুতে মোটরসাইকেল আমদানি করে ৫০ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেয়ার ঘটনা ধরা পড়ে। রাজস্ব ফাঁকির ঘটনা তদন্ত করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ঢাকার আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান টিভিএস অটো বাংলাদেশ লিমিটেড মোটরসাইকেলের খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানির ঘোষণা দেয়। কিন্তু ঘোষণা অনুযায়ী খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানি না করে বেনাপোল বন্দর দিয়ে কয়েকশ পূর্ণাঙ্গ (কমপ্লিট) মোটরসাইকেল আমদানি করে প্রতিষ্ঠানটি।
শুল্ক গোয়েন্দা ও কাস্টম হাউস সূত্র জানায়, কম্পিলিট মোটরসাইকেলের সঠিক এইচএস কোড-৮৭১১.১০২১ (টিটিআই) যার ডিউটি-৮৯ দশমিক ৩২ শতাংশ । আর মোটর সাইকেলের যন্ত্রাংশ আমদানির এইচএস কোড ৮৭১৪.১০৯০ (টিটিআই)- যার ডিউটি ৫৮ দশমিক ৬০ শতাংশ । মেসার্স শামসুর রহমান উক্ত কোড পরিবর্তন করে ইনভয়েজ শুল্কায়নপূর্বক ২৮টি পণ্য চালানে সরকারের ৮ কোটি ৩০ লাখ ৩ হাজার ৪৪ টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হয়। এলসি, এলসিএ ইনভয়েস, প্যাকিং লিস্ট ও কায়িক পরীার প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায় প্রকৃত ইনভয়েস জাল করে সিকেডি (কমপ্লিট) মোটরসাইকেলকে পার্টস অব মোটরসাইকেল ঘোষণা দিয়ে শুল্ক ফাঁকি দেয়া হয়েছে। আমদানিকারকের দাখিল করা এলসিএ পণ্য চালানের বিবরণে রয়েছে- টিভিএস রেডিঅন ১১০ সিসি ইএস এমসিওয়াই পার্টস অ্যান্ড কম্পোনেন্টস ইন সিকেডি, কিন্তু কাস্টমসের অ্যাসাইকোডা ওয়ার্ল্ডে পাওয়া যায় ভিন্ন। প্যাকিং লিস্টে চালানের নাম পার্টস অব কম্পোনেন্টস অব টিভিএস ব্রান্ড মোটরসাইকেল টিবিএস রেডিঅন ১১০ সিসি। কাস্টমের প থেকে বারবার রাজস্ব ফাঁকির অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা দেয়ার কথা বলা হলেও জমা না দিয়ে বরং উল্টো সময় নেয়া হচ্ছে। উল্লেখ্য, মোটরসাইকেলের এসব চালান কোনো ফিজিক্যালি পরীা না করেই গোপনে খালাস দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। বেনাপোল কাস্টম হাউসের কমিশনার আজিজুর রহমান রাজস্ব ফাঁকির বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, দাবিনামা জারি করে ইতোমধ্যে আমদানিকারক ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টকে চিঠি দেয়া হয়েছে। অভিযুক্ত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট মেসার্স শামসুর রহমানের মালিক শামসুুর রহমানকে ফাঁকি দেয়া রাজস্ব সরকারি কোষাগারে জমা দেয়ার জন্য বলা হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সরকারের টাকা জমা না দিলে লাইসেন্স বাতিলসহ তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হবে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। কাস্টম কমিশনার আজিজুর রহমান বলেন শুল্ক ফাকির বিষয়টা অবশ্যয় অন্যায় এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তিনি বলেন যে বা যারা এই শুল্ক ফাকির সাথে জড়িত তাদের প্রত্যেকে শাস্তির আওতায় আনা হবে।
সূত্র জানায়, টিভিএস অটো বাংলাদেশ লিমিটেড ও বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট মেসার্স শামসুর রহমান এবং সুজন এন্টারপ্রাইজ জালিয়াতির মাধ্যমে বড় ধরনের শুল্ক ফাঁকি দেয়। পণ্য চালানে এলসি, ইনভয়েজ ও প্যাকিং লিস্ট জালিয়াতি করে শুল্ক ফাঁকি ও মানি লন্ডারিং করা হয়েছিল বলে অভিযোগ যায় এনবিআরে। আর তাদের সহযোগিতা করেন বেনাপোল কাস্টমসের সাবেক কমিশনার বিল্লাল হোসেইন। মেসার্স শামছুর রহমানের স্বত্বাধিকারী ও বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি বিএনপি নেতা শামছুর রহমানের বিরুদ্ধে শুল্ক ফাঁকির ঘটনা পুরনো। প্রতি বছরই মেসার্স শামসুর রহমান
বেনাপোল কাস্টম সূত্র জানায়, শামছুর রহমানসহ বেনাপোলের ১০ জন সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ীর শুল্ক ফাঁকির অভিযোগ যায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। সেখান থেকে বিষয়টি খোঁজ নিতে এনবিআরকে চিঠি দেয়া হয়। পরে এনবিআর তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে।
শুল্ক ফাঁকির অভিযোগ রয়েছে এমন বাকি নয়টি প্রতিষ্ঠান হলো শামছুর রহমানের ছোট ভাই জয়েন্ট এন্টারপ্রাইজের মালিক হাবিবুর রহমান, তাদের ভাগ্নে মেসার্স অর্ণব এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. এমদাদুর রহমান বাবু, সোহান ট্রেডের মালিক আহসান হাবীব সেলিম, লিটন এন্টারপ্রাইজের মালিক যুবদল নেতা নুরুজ্জামান লিটন, বিশ্বাস এন্টারপ্রাইজের আব্দুল মোত্তালিব, মিলিনিয়ামের মালিক দিলাল উদ্দিন, আনুষা ইমপ্লেক্সের মো. নুরুল আলম স্বপন, রাতুল ইন্টারন্যাশনালের মো. আব্দুল লতিফ এবং জামান ট্রেডার্সের খায়রুজ্জামান মধু। এ অভিযোগের বিষয়ে মেসার্স শামছুর রহমানের স্বত্বাধিকারী শামছুর রহমান বলেন, আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ আনা হয়েছে। আমি তদন্ত কমিটির কাছে লিখিত ব্যাখ্যা দিয়েছি। আমার মতো সবাই লিখিত ব্যাখ্যা জমা দিয়েছে। মেসার্স অর্ণব এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. এমদাদুর রহমান বাবুও একই ধরনের কথা জানান। তিনি বলেন, আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। অযথা হয়রানির উদ্দেশ্যে মিথ্যা অভিযোগ করা হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করে বেনাপোল কাস্টমসের কমিশনার আজিজুর রহমান জানান, তদন্ত কমিটি দুদিন ধরে কাজ করে ফিরে গেছে। পরে তারা এনবিআরে তদন্ত রিপোর্ট জমা দেবে। অভিযোগগুলো প্রমানিত হলে সেখানে তারা সুপারিশ করবে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া যায়। এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটির প্রধান ও মোংলা কাস্টমস কমিশনার হোসেন আহমদ জানান, আমরা খুব বেশি তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই তদন্তে নেমেছিলাম। তার পরও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রমাণ জোগাড় করেছি। শিগগিরই তদন্ত রিপোর্ট জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে জমা দেব। দেশের সর্ববৃহৎ স্থলবন্দর বেনাপোলে শুল্ক ফাঁকির ঘটনা পুরনো। প্রতি বছর গড়ে দুই শতাধিক শুল্ক ফাঁকির ঘটনা ঘটলেও যারা শুল্ক ফাঁকি দিচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। গত ১০ অর্থবছরে বেনাপোলে দুই হাজারের বেশি শুল্ক ফাঁকির ঘটনা ধরেছে কাস্টমের শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ। এসব ঘটনায় কয়েক হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকির ঘঁনা ঘটেছে। অতীতে এসব ঘটনায় যারা অভিযুক্ত তাদের বিরুদ্ধে শুধু জরিমানা আদায় করে ছেড়ে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুল্ক ফাঁকির সঙ্গে সরাসরি আমদানিকারক, সিঅ্যান্ডএফ প্রতিনিধিরা জড়িত। আর এদের প্রত্যভাবে সহযোগিতা করেন কাস্টমের কতিপয় কর্মকর্তা। যে কারণে শুধু জরিমানা আদায় ছাড়া আর কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয় না কাস্টমস কর্তৃপ। এতে শুল্ক ফাঁকিবাজরা উৎসাহিত হচ্ছেন। সরকার হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব।