কৃষকনেতা শেখ মাহমুদুল হক মনিপীরের ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকী পালিত

0
265

স্টাফ রিপোর্টার : বাংলাদেশ কৃষক সংগ্রাম সমিতি কেন্দ্রীয় কমিটির উদ্যোগে কৃষকনেতা শেখ মাহমুদুল হক মনিপীরের ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ থানার গোপালপুরস্থ সমাধিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ, প্রয়াত নেতার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন ও শপথ পাঠ করা হয়। ১৭ ডিসেম্বর ২০২০ বৃহস্পতিবার সকাল ১০ টায় এক সংক্ষিপ্ত স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়। সংগঠনের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি সাখাওয়াত হোসেনের সভাপতিত্বে স্মরণসভায় প্রধান অতিথি হিসাবে বক্তব্য রাখেন জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি তোজাম্মেল হোসেন। অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ কৃষক সংগ্রাম সমিতির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক কামরুল হক লিকু ও প্রয়াত কৃষকনেতা সহকর্মি জনাব ইসহাক প্রমুখ।
প্রধান অতিথি তার বক্তব্যে কৃষকনেতা মণিপীরের কর্মময় সংগ্রামী জীবনের ওপর আলোকপাত করে তা থেকে শিক্ষা নিয়ে কৃষক ও কৃষির সমস্যা সমাধানে সর্বস্তরের কৃষক-জনতাকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, দেশের কৃষক নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত। বলতে গেলে এখনও দেশের কৃষক প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল হয়েই তার কৃষিকাজ চালিয়ে যাচ্ছে। নেতৃবৃন্দ বলেন, কৃষি জমি ধ্বংস রোধ, খাস জমি ভূমিহীন গরিব কৃষকদের মাঝে বণ্টনসহ ৭ দফা দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার বিকল্প নাই। ভারতের চলমান কৃষক আন্দোলনের প্রতি সংহতি জ্ঞাপন করে নেতৃবৃন্দ বলেন, বাজার অর্থনীতির নামে আমাদের দেশের কৃষিপণ্যের দাম যেমন সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালালদের ওপর ছেড়ে দিয়েছে অতিতের সরকারগুলি ভারতের বর্তমান সরকারও নতুন কৃষি আইনগুলির নামে তাদের কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যে মূল্য বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে অপচেষ্টা করছে। করোনা মহামারীতে মধ্যবিত্ত-নি¤œমধ্যবিত্ত, ছোট ব্যবসায়ীসহ প্রায় সাড়ে ৩ কোটি মানুষ কর্মসংস্থান হারিয়ে দিশেহারা। আর প্রবাসে প্রায় ১ কোটি শ্রমিকের কর্মসংস্থান ঝুঁকিতে পড়েছে। প্রায় অর্ধকোটি শ্রমিককে দেশে ফিরতে বাধ্য হতে হচ্ছে বলে পত্রিকান্তে জানা যাচ্ছে। গ্রামে সাড়ে ৩ কোটি ভূমিহীন-গরীব কৃষকের সাথে উক্ত কর্মহীনরা যুক্ত হয়ে গ্রামাঞ্চলে কর্মহীন মানুষের তালিকা বৃদ্ধি করছে। সামগ্রিক ক্ষয়ক্ষতি অপরিসীম। এই পরিস্থিতিতে আমরা কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে কৃষক, কৃষি ও কৃষি নির্ভর শিল্পসহ ব্যবসা-বাণিজ্যকে সর্বাধিক গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় ১২শ কোটি টাকা ব্যয় করে পাটকলগুলি আধুনিকায়ন না করে ৬হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তা বন্ধ করা হয়েছে। ফলে নিয়মিত-অনিয়মিত প্রায় দেড় লক্ষ শ্রমিককে বেকার করা হয়েছে। নতুনভাবে দেশের ১৬ টি সুগার মিলের মধ্যে ৮টি সুগার মিল বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ খাদ্য ও চিনি শিল্প কর্পোরেশন। ইতোমধ্যে কুষ্টিয়া চিনিকল বন্ধ ঘোষণাসহ ৬টি চিনিকলের মাড়াই বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এক তথ্যে জানা যায়, দেশের ১৪ লাখ টন চাহিদার বিপরীতে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন মিলগুলোতে চিনি উৎপাদিত হয় মাত্র ৭৭ হাজার ৪৫০ টন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, বাংলাদেশে বার্ষিক মাথাপিছু চিনির চাহিদা ৯ কেজি। পাট ও চিনিশিল্পের ক্ষেত্রে লোকসানকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছে। কিন্তু এর কারণ, দায়-দায়িত্ব শ্রশিকের ওপর চাপানো হয়েছে যা কোন ভাবেই সঠিক নয়। এর জন্যে মূলত দায়ি অব্যবস্থাপনা, লুটপাট, অনিয়ম, দুর্নীতি, মাথাভারী প্রশাসন, মান্ধাত্বার আমলের যন্ত্রপাতি ইত্যাদি। এর সমাধান না করে লোকসানের অজুহাত তুলে বন্ধ করা হচ্ছে মূলত বিশ্বব্যাংক-আইএমএফর নীতি-নির্দেশ কার্যকরি করে দেশ-বিদেশিদের লুটেরাদের লাভবান করার জন্য। সঙ্কটের সমাধান না করার জন্যে মিলের উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। ফলে অবাধ বাজার অর্থনীতির সুযোগে আমদানীকৃত চিনির মূল্যের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। ব্যক্তিমালিকানাধীন চিনিকল ও আমদানীকৃত চিনির মূল্য কম হওয়ায় রাষ্ট্রায়াত্ব চিনিকলের চিনি বিক্রি হচ্ছে না। ফলে রাষ্ট্রায়াত্ব কারখানাগুলি উৎপাদন ব্যয় মেটাতে সঙ্কটের মধ্যে পড়েছে। শ্রমিকরা সময় মত বেতন পাচ্ছে না। কৃষকরাও আখ সরবরাহ করে টাকা পাচ্ছে না। ফলে কৃষকেরা আখের চালান (পুর্জি) মধ্যসত্বএভাগিদের কাছে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়। যে কারণে কৃষক উৎপাদনে নিরুৎসাহিত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য হারে আখের উৎপাদন কমেছে। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের (ডিএই) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে মোট দুই লাখ ৮১ হাজার একর জমিতে ৫৫ লাখ টন আখ উৎপাদন হয়। চলতি অর্থবছরে যা কমে প্রায় অর্ধেকে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে দেড় লাখ একর জমিতে আখ চাষ হয়েছে। বাংলাদেশ যখন রাষ্ট্রায়ত্ব চিনিকলগুলির বড় অংশ বন্ধের দিকে যাচ্ছে তখন অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ২০২০-২১ মৌসুমে ভারত সরকার ৬০ লাখ টন চিনি রপ্তানিতে ভর্তুকি দিচ্ছে। ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো জানায়, আখ চাষিদের বিপুল অঙ্কের বকেয়া রয়েছে, তা পরিশোধ করার জন্যই প্রায় তিন হাজার ৬০০ কোটি রুপি ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে।
সামগ্রিক সঙ্কটময় মূহুর্তে খাদ্য নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থান তথা জাতীয় স্বার্থে জাতীয় শিল্প বিকাশের উপযোগি নীতি এবং দক্ষ ও স্বচ্ছতা-জবাবাদিহিতাপূর্ণ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করাসহ দেশের চিনিকলগুলি আধুনিকায়ন মাধ্যমে জাতিকে রক্ষা করা সম্ভব। শ্রমিক-কর্মচারী ও আখচাষিদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থার বিষয়টিও বিবেচনার দাবি রাখে। সর্বোপরি আখ থেকে শুধু চিনি উৎপাদন হয় না। ইথানল, বিদ্যুৎ উৎপাদন, কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণসহ বহুমুখী প্রকল্প নেওয়া প্রয়োজন। এমতাবস্থায় আখচাষী ও শ্রমিকদের বকেয়া পাওনা পরিশোধ এবং চিনিকল বন্ধ বা ব্যক্তিমালিকানায় হস্তান্তর নয়, আধুনিকায়ন ও বহুমুখিকরণের দাবি জানাই।
সভাপতি তার সমাপনি বক্তব্যে বলেন, কৃষকনেতা মণিপীর সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালালদের উচ্ছেদ করে কৃষি বিপ্লব তথা জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে অগ্রসর করতে যেভাবে আমৃত্যু সংগ্রাম করেছেন তা থেকে শিক্ষা নিয়ে শ্রমিক-কৃষক-জনগণের রাষ্ট্র, সরকার ও সংবিধান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সকলকে শামিল হওয়ার আহ্বান জানান। একই সাথে ধানসহ কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত, সরকারী ক্রয় কেন্দ্রের অধীনে জেলার প্রতিষ্ঠিত হাটবাজারগুলোতে অস্থায়ী ক্রয় কেন্দ্রের মাধ্যমে সরাসরি কৃষকের নিকট থেকে ক্রয়ে যথাযথ ব্যবস্থা, অতিরিক্ত টোলা আদায় ও ওজনে কারচুপির বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ভূমিহীন-গরিব কৃষকদের মাঝে পূর্ণ রেশনিং ব্যবস্থাসহ পেঁয়াজসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য জনসাধারণের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে আনার জন্যে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিতে আন্দোলন অগ্রসর করার আহ্বান জানান।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here