নূর ইসলাম : যশোরের বর্ষীয়ান রাজনীতিক সাবেক সংসদ সদস্য ও প্রতিমন্ত্রী খালেদুর রহমান টিটোর (৭৬) মারা গেছেন(ইন্না লিলাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। আজ শনিবার দুপুর একটা ২০ মিনিটে যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তার মৃত্যু নিশ্চিত করেন। মরদেহ বেলা তিনটার দিকে সিএমএইচ থেকে মরহুমের ষষ্ঠিতলাপাড়ার নিজবাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। এরআগে সকাল দশটার দিকে শারীরিক অবস্থা গুরুতর হয়ে উঠলে টিটোকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। তার মেজ ছেলে অ্যাডভোকেট খালিদ হাসান জিউস জানান, ফুসফুসে ইনফেকশনজনিত কারণে তিনদিন আগে তাকে যশোর সেনাননিবাসস্থ সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আজ সকাল দশটার দিকে অবস্থার অবনতি হলে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়।
এদিকে বর্ষিয়ান এই রাজনীতিকের মৃত্যুতে যশোরের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিরাজ করছে শোকাহত পরিবেশ। টিটোর মৃত্যু সংবাদে যশোরের সর্বস্তরের রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ তার বাসভবনে ভিড় জমাতে শুরু করে দুপুরের পর থেকেই। অনেকেই শোকাহত পরিবারের সদস্যদের শান্তনা জানাতে গিয়ে নিজেরাই অ¤্রুসজল হয়ে পড়েন। সরকারী দল আওয়ামীলীগের এই নেতার মৃত্যুর সংবাদে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা মরহুমের বাড়িতে ছুটে যান। জেলা বিএনপি, জাতীয় পার্টি, বাম গণতান্ত্রিক মোর্চার নেতৃবৃন্দ, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নেতৃবৃন্দসহ সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা মরহুমের বাড়িতে ছুটে যান এবং শোক সন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের শান্তনা জানান। প্রেসক্লাব যশোরের সভাপতি জাহিদ হাসান টুকুন ও সম্পাদক আহসান কবির এক শোক বিবৃতিতে মরহুমের প্রতি গভীর শোক প্রকাশ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
উল্লেখ্য খালেদুর রহমান টিটো, তরিকুল ইসলাম ও আলী রেজা রাজু যশোরের রাজনৈতিক অঙ্গনের ধ্রুবতারা হিসেবে পরিচিত ছিলেন সর্বমহলে।এই তিন জন ঘনিষ্ঠ বন্ধুও ছিলেন। আমৃত্যু তাদের বন্ধুত্ব অটল ছিল। রাজনৈতিক মতপার্থক্য বা ভিন্নতা থাকলেও তাদের বন্ধুত্বে তা কখনো ফাটল ধরাতে পারেনি।২০১৬ সালে আলী রেজা রাজু, ২০১৮ সালে তরিকুল ইসলাম ও সর্বশেষ আজ ১০ নভেম্বর খালেদুর রহমান টিটো মারা যাওয়ায় তিন বন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের এক পরিসমাপ্তি ঘটলো।
টিটোর বাড়িকত ছুটে গেলেন যারা :
খবর শুনে খালদেুর রহমান টটিোর মরদহে দখেতে তার বাড়তিে যান স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতমিন্ত্রী স্বপন ভট্টার্চায্য, যশোর-৬ আসনরে সংসদ সদস্য ও জলো আওয়ামী লীগরে সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার, সভাপতি শহদিুল ইসলাম মলিন, যশোর-২ আসনরে সাবকে সংসদ সদস্য অ্যাডভোকটে মনরিুল ইসলাম মনরি, ন্যাপরে কন্দ্রেীয় সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকটে এটএিম এনামুল হক, বাংলাদশেরে ওর্য়ার্কাস র্পাটরি (র্মাকসবাদী) কন্দ্রেীয় সাধারণ সম্পাদক ইকবাল কবরি জাহদি, বএিনপরি খুলনা বভিাগীয় সহ-সাংগঠনকি সম্পাদক অনন্দ্যি ইসলাম অমতি, জলো বএিনপরি আহ্বায়ক অধ্যাপক র্নাগসি বগেম, সদস্য সচবি অ্যাডভোকটে সয়ৈদ সাবরেুল হক সাবু, বএিনপি নতো আলহাজ মজিানুর রহমান খান, দলেোয়ার হোসনে খোকন, নগর সভাপতি ও সাবকে ময়ের মারুফুল ইসলাম, মণরিামপুর উপজলো সভাপতি অ্যাডভোকটে শহদি ইকবাল, জাতীয় র্পাটরি সাবকে জলো সভাপতি অ্যাডভোকটে মাহবুব আলম বাচ্চু, র্বতমান সভাপতি শরফিুল ইসলাম চৌধুরী সরু, যশোর পৌরসভার কাউন্সলির মকসমিুল বারী অপু, হাববিুর রহমান চাকলাদার মন,ি সন্তোষ দত্ত প্রমুখ।
এদকিে খালদেুর রহমান টটিোর মৃত্যুতে শোক জানয়িে ববিৃতি দয়িছেনে যশোর বজ্ঞিান ও প্রযুক্তি বশ্বিবদ্যিালয়রে (যবপ্রিব)ি উপার্চায অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসনে। শোকর্বাতায় তনিি বলনে, ‘খালদেুর রহমান টটিো ছলিনে যশোর বজ্ঞিান ও প্রযুক্তি বশ্বিবদ্যিালয়রে র্সবােচ্চ নীত-িনর্ধিারণী ফোরাম রজিন্টে র্বোডরে সদস্য । তনিি ছলিনে তৃণমূল থকেে উঠে আসা একজন বলষ্ঠি রাজনীতবিদি। খটে-েখাওয়া মহেনতি মানুষরে জন্য তনিি আজীবন কাজ করছেনে। আমি তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করছি এবং বদিহেী আত্মার মাগফরিাত কামনা করছ।ি’
অনরূপ শোক ববিৃতি দয়িছেে যশোর বজ্ঞিান ও প্রযুক্তি বশ্বিবদ্যিালয়রে শক্ষিক সমতি,ি র্কমর্কতা সমতিি ও র্কমচারী সমতি।ি একইসঙ্গে যবপ্রিবি ছাত্রলীগ, সাংবাদকি সমতিসিহ বশ্বিবদ্যিালয়রে বভিন্নি সামাজকি ও সাংস্কৃতকি সংগঠনও তার প্রয়াণে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করছে।ে
শোক প্রকাশ করছেনে প্রসেক্লাব যশোররে সভাপতি জাহদি হাসান টুকুন ও সম্পাদক আহসান কবীর। এক যুক্ত ববিৃততিে তারা বলনে, টটিোর মৃত্যুতে যশোরবাসী রাজনতৈকি অভভিাবকশূন্য হলো। তারা মরহুমরে আত্মার শান্তি ও শোকসন্তপ্ত পরবিাররে প্রতি সমবদেনা জানান।
এছাড়া গভীর শোক প্রকাশ ও শোকাহত পরবিাররে প্রতি সমবদেনা জানয়িে ববিৃিতি দয়িছেনে সাংবাদকি ইউনয়িন যশোররে সভাপতি শহদি জয় ও সাধারণ সম্পাদক আকরামুজ্জামান। এক ববিৃততিে তারা খালদেুর রহমান টটিোর রুহরে মাগফরোত কামনা করনে।
টিটোর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন ঃ
খালেদুর রহমান টিটো ১৯৪৫ সালের ১ মার্চ কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মরহুম অ্যাডভোকেট হবিবুর রহমান। তিনি একজন এমএ, বিএল ছিলেন। মা মরহুম করিমা খাতুন একজন এমএ, এম-এড ছিলেন। সাত ভাইবোনের মধ্যে টিটো দ্বিতীয়। বড়ভাই মাসুকুর রহমান তোজো ১৯৭১ সালে রাজাকার বাহিনীর হাতে নৃশংসভাবে খুন হন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ডবল অনার্স নিয়ে ফিজিক্সে মাস্টার্স পাশ করেছিলেন।
রাজনৈতিক সহকর্মী ও পরিবার সদস্যদের দেওয়া তথ্যমতে, খালেদুর রহমান টিটোর শিক্ষাজীবন শুরু হয় যশোর জিলা স্কুলে। ১৯৬০ সালে এখান থেকে তিনি ম্যাট্রিকুলেশান পাশ করেন। ১৯৬৩ সালে ঢাকার কায়েদে আজম কলেজ হতে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। ১৯৬৭ সালে কারাগারে অবস্থানকালে যশোর এমএম কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন করেন। পরবর্তীতে মাস্টার্স করতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগে ভর্তি হয়েও রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে মাস্টার্স আর শেষ করা সম্ভব হয়নি।
খালেদুর রহমান টিটো রাজনৈতিক পরিমন্ডলে বেড়ে উঠেছেন। ১৯৬৩ সালে যশোর এমএম কলেজ ছাত্র ইউনিয়নে সম্পৃক্ততার মধ্যদিয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় হন।
১৯৬৭ সালে কলেজের লেখাপড়া শেষে করে তিনি বাম ধারার শ্রমিক রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৬৯ সালের শেষের দিকে তিনি কৃষক আন্দোলন জোরদার করতে কোটচাঁদপুর, মহেশপুর ও কালীগঞ্জ এলাকায় যান। ১৯৭০ সালের শেষের দিকে তার সাথে দলের রাজনৈতিক মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। শ্রেণিশত্রু উৎপাটনের লাইন তিনি মেনে নিতে পারেননি। ফলে এক সময়ে দল থেকে বের হয়ে আসেন। এসময় তিনি পুলিশি অভিযানের কারণে কুষ্টিয়ায় চলে যান। ওই বছরের মার্চ মাসে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি আবার ভারতে চলে যান। বাম রাজনীতির সাথে জড়িত থাকার কারণে সেখানে তিনি শান্তিতে থাকতে পারেননি। আবার পূর্ব পাকিস্তানেও ঢুকতে পারতেন না। এর কারণ হিসেবে ওই সময় পাকিস্তানি আর্মি তার মাথার দাম ধার্য করেছিল দশ হাজার টাকা।
স্বাধীনতার পর তিনি দেশে ফিরে আসেন। ইতোমধ্যে বড়ভাই মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হলে সংসারের দায়িত্ব তার কাঁধে এসে পড়ে। সাংসারিক ব্যয়ভার বহন করার জন্য তিনি ব্যবসা শুরু করেন এবং আব্দুস সামাদ মেমোরিয়াল স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি গ্রহণ করেন। ১৯৭৪ সালের প্রথমদিকে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাসানী-ন্যাপ) এ যোগ দেন। ১৯৭৪ সালেই ন্যাপের জেলা সম্পাদকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৭৮ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় তিনি ন্যাপের পক্ষ থেকে জিয়াউর রহমানকে সমর্থন করেন। নির্বাচনের পর বিএনপি নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠিত হয়। তবে তিনি এই দলে যোগ না দিয়ে ন্যাপের সাথেই থেকে যান। ১৯৮১ সালে ‘গণতান্ত্রিক পার্টি’ গঠিত হলে তিনি এই রাজনৈতিক দলে যোগ দেন। গণতান্ত্রিক পার্টির স্টান্ডিং কমিটির ১১ সদস্যের মধ্যে তিনি ছিলেন। ১৯৮৪ সালে যশোর পৌরসভার নির্বাচনে তিনি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৮৬ সালে তিনি জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৭ সালে তিনি জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক হন। ১৯৯০ সালের মে মাসে তিনি শ্রম ও জনশক্তি প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। সরকার পতনের পর ১৯৯১ সালে তাকে জেলে যেতে হয়। ১৯৯১ এর শেষে জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর পার্টির চেয়ারম্যান জেনারেল এরশাদের সঙ্গে তার মতবিরোধ হয়। ওই সময় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া তাকে দলকে সহযোগিতা করার প্রস্তাব দেন। ২০০১ সালের নির্বাচনে তাকে যশোর সদর আসনে টিকেট না দেওয়ায় তিনি নির্বাচন বয়কট করেন।
২০০৫ সালে আওয়ামীলীগ প্রধান খালেদুর রহমান টিটোকে তার দলে যোগদানের জন্য আহ্বান জানান। ২০০৬ সালে ১১ জানুয়ারি দেশে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসে। ওই সরকার ২০০৮ সালের ২৯ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করলে যশোর থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নমিনেশন পান সাবেক এমপি আলী রেজা রাজু। কিন্তু কিছুদিন পর রাজুর বদলে খালেদুর রহমান টিটোকে যশোর সদর আসনে নমিনেশন দেওয়া হয়। খালেদুর রহমান টিটো তার প্রতিপক্ষ বিএনপিনেতা, সাবেক মন্ত্রী তরিকুল ইসলামকে নির্বাচনে পরাজিত করে যশোর সদর আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৭২ সালের ১৮ মে যশোর শহরের চুটিপট্টির মেয়ে রওশন আরা বেগমের সঙ্গে সংসারজীবন শুরু করেছিলেন টিটো। তাদের তিন ছেলে। ২০০৭ সালে স্ত্রী রওশন মারা যান।