বাঘারপাড়া সংবাদদাতা : যশেরের বাঘারপাড়া ও নড়াইল জেলার সদর উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল (১১ টি গ্রাম) এগারোখান। যেখান থেকে যে কোনো সরকারি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বা হাসপাতালের দুরত্ব ২০ থেকে ৩০ কিলোমিটার। এরকমই একটি এলাকার করোনা নিয়ন্ত্রনে, “গ্রাম আমার সুরক্ষার দায়িত্বও আমার” শ্লোগানকে সামনে রেখে নিরলস কাজ করে চলেছেন একদল স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। এলাকার মানুষের জ্বর সর্দি কাশির খবর জানতে পারলেই, অক্সিজেন সিলিন্ডার ও ঔষধ সামগ্রী নিয়ে তাৎক্ষনিক ছুটে যাচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। ২৪ ঘন্টাই তারা নিবেদিত। এলাকার ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়র, ব্যাংকার, সরকারি- বেসকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, শিক্ষকসহ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া শিক্ষার্থিীদের নিয়েই এ করোনা মোকাবেলা করে যাচ্ছেন। অতি দরিদ্রদের জরুরী খাদ্য সহায়তার কার্যক্রমও শুরু হতে চলেছে। ১১খানের এ উদ্যোগ এখন সর্বত্রই প্রশংসিত। এঁদের দেখাদেখি অন্যান্য এলাকাও নেওয়া হচ্ছে এ মহতি উদ্যোগ। সরেজমিনে ১১খানে দেখা যায়, রাস্তার মোড়ে মোড়ে করোনা সচেতনতার ব্যানার বিলবোর্ডে ছেয়ে গেছে। মোড়ে মোড়ে দাড়িয়ে আছে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। তারা বাড়ি বাড়ি লিফলেট বিতরণ করছেন। বিতরণ করছেন স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রীও। গুয়াখোলা কমিউনিটি সেন্টারে করোনা টেস্টের জন্য লম্বা লাইনও চোখে পড়ে। করোনা প্রতিরোধ কমিটির সদস্য সচিব অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) বিপ্লব সেন বলেন, আমাদের চেষ্টায় নড়াইল সিভিল সার্জন অফিস থেকে এই কমিউনিটি সেন্টারে সরকারি খরচে করোনা টেষ্টের আয়োজন করা হয়েছে। সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কাজের গতি আনার জন্য, ১১খানের সমগ্র অঞ্চলকে তিনটি ইউনিটে ভাগ করা হয়েছে। নড়াইল সদরের শেখহাটি ইউনিয়নের চারটি গ্রাম (মালিয়াট, বাকলি, হাতিয়াড়া ও গুয়াখোলা) নিয়ে ১নম্বর ইউনিট। বাঘারপড়ার জামদিয়া ইউনিয়নের ছয়টি গ্রাম (ঘোড়ানাছ, দোগাছি, কমলাপুর, রঘুরামপুর, কিসমতবাকড়ী ও বাকড়ী) নিয়ে ২নম্বর ইউনিট এবং নড়াইল সদরের তুলারামপুর ইউনিয়নের বেনাহাটি গ্রামকে ৩নম্বর ইউনিট করা হয়েছে। প্রত্যেক ইউনিটে সার্বক্ষনিক একজন সমন্বায়ক ও চারজন এমবিবিএস ডাক্তার পালাক্রমে অনলাইনে চিকিৎসা পরামর্শ দিচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, প্রত্যেক গ্রামের জন্য একজন গ্রাম্য ডাক্তারের অধিনে একটি কমিটি আছে। তাদের মাধ্যমে ১১খানে বসবাসকারি ২৫০০ পরিবারের মোবাইল নম্বর ও সদস্য সংখ্যা চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রত্যেক বাড়িতে ইউনিট প্রধানের মোবাইল নম্বরও দেওয়া হচ্ছে। করোনার বিন্দুমাত্র উপসর্গ দেখা গেলেই পরিবার থেকে ইউনিট প্রধানকে ফোনে জানাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে প্রশিক্ষিত কর্মিরা সেখানে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সামগ্রী নিয়ে হাজির হচ্ছেন।
এ সময় কথা হয় একজন করোনা পজিটিভ রোগির সন্তান, গুয়াখোলা গ্রামের সঞ্জয় বিশ্বাসের সাথে। তিনি বলেন, আমার বাবা কানাই বিশ্বাসের (৮৫) কয়েক দিন ধরে জ্বর চলছিলো। প্রথম দিকে গুরুত্ব দিইনি। একদিন রাত ১১টায় তাঁর শ্বাস কষ্ট শুরু হয়। সঙ্গে সঙ্গে করোনা প্রতিরোধ কমিটিকে জানাই। তারা এসে বাবাকে অক্সিজেন সহ ঔষধপত্র দিয়ে অপেক্ষায় থাকে। এরপর সকালে বাবাকে নড়াইল সদর হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দেওয়ার দুই দিন পর বাবা পুরোপুরি সুস্থ হয়ে এখন বাড়িতেই আছেন। এই দুর্গম এলাকায় এই বাহিনী না থাকলে আমার বাবাকে বাঁচাতে পারতাম না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
করোনা প্রতিরোধ কার্যক্রমের সার্বিক সমন্বয়ক বেক্সিমকো গ্রুপের গিগাটেকের সহকারী ব্যবস্থাপক বাপ্পা সরকার বলেন, যশোর মেডিকেল কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক ডাঃ নিকুঞ্জ বিহারি গোলদার, খুলনার আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালের সাবেক পরিচালক ডাঃ বিধান চন্দ্র গোস্বামী ও সিরাজগঞ্জ মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ডাঃ সঞ্জয় পাঠক। এলাকার এই তিন কৃতি সন্তানের প্রাথমিক ধারণা এবং তাঁদের সার্বিক নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধানে আমরা ১১খানে করোনা মোকাবেলা করে চলেছি। ইতিমধ্যে এ কার্যক্রমের সুফলও দেখা যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, আমরা কভিড-১৯ মহামারীর ভয়াবহতা ও সুরক্ষা পদ্ধতি সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরি করা, করোনা মোকাবেলায় সরকার ঘোষিত প্রজ্ঞাপন সাধারন মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া ও তা পালনে উৎসাহিত করা, নাগরিকদের মাঝে অক্সিমিটার ও থার্মোমিটার সরবরাহ করে চলেছি। এ ছাড়াও জ্বর সর্দি কাশি হলেই নির্ধারিত মেডিকেল ও নন-মেডিকেল টিমের মাধ্যমে প্রটোকল অনুযায়ি সেবা দিচ্ছি। নাগরিকদের সামান্য উপসর্গ থাকলেই তাদের আইসোলেশরন রাখার ব্যবস্থা করছি। এরপর যদি রোগির অবস্থা শঙ্কটাপন্ন হয় তবে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করছি। তিনি আরও বলেন, এলাকার ২০জন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, ১০০এর উপরে স্কুল কলেজ পড়–য়া শিক্ষার্থী ২০জন মেডিকেল এসিস্ট্যান্ট ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গ্রাম্য চিকিৎসক অনলাইনে বা সরাসরি করোনা মোকাবেলায় কাজ করে চলেছেন। এখন আগের চেয়ে জ্বর শর্দি কাশিতে আক্রান্ত রোগির সংখ্যা অনেক কমে এসেছে। এ কাজে অর্থায়নের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে বাপ্পা বলেন, বাংলাদেশ ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ১১ খান অঞ্চলের লোক জন আছে। তাদের সামর্থ অনুযায়ি কেউ নগদ টাকা বা চিকিৎসা সামগ্রী পাঠাচ্ছেন। কেউ কেউ করোনা সুরক্ষা সামগ্রীও পাঠাচ্ছেন। এ ছাড়াও যারা বাকড়ী স্কুলে লেখাপড়া করেছেন কিন্তু ১১খানের নাগরিক না, তারাও অনুদান পাঠাচ্ছেন। এ বিষয়ে নড়াইল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাদিয়া ইসলাম বলেন, ‘এমন প্রত্যন্ত অঞ্চলে গৃহিত এ কার্যক্রম অবশ্যই প্রসংশার দাবি রাখে। এবং অন্যদেরও অনুকরনীয়। কারন সরকারের একার পক্ষে সকল প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবেলা করা সম্ভব নয়’। তিনি আরও বলেন, ‘যদি আমার কাছে কোনো সহযোগিতা চায় তবে অবশ্যই তা পুরণ করা হবে’। বাঘারপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তানিয়া আফরোজ বলেন, ‘এটা অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত ও প্রশংসনীয় উদ্যোগ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এটাই আশা করেন। এ মহত কাজে তাঁরা যে কোনো প্রকার সাহায্য চাইলে আমার সাধ্যমত সহযোগিতা করবো’। তিনি আরও বলেন,‘প্রতি ইউনিয়নে যদি এরকম উদ্যোগ জনসাধারণ গ্রহণ করে তবে, সরকারের পক্ষে করোনা মোকাবেলা অত্যান্ত সহজ হবে।