মালিকুজ্জামান কাকা, যশোর : দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (হাবিপ্রবি) এ দুটি উচ্চ ফলনশীল করলার এইচএসটিইউ-১’ ও ‘এইচএসটিইউ-২ নামের নতুন দুইটি জাত উদ্ভাবন করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের পিএইচডি গবেষক ফররুখ আহমেদের গবেষণায় এবং প্রফেসর ড. মো. হাসানুজ্জামান তত্ত্বাবধানে করলার এই জাত দুইটি উদ্ভাবন করেছে। নতুন জাতের করলার একর প্রতি ফলন ১১.২ টন বলে জানিয়েছেন গবেষকরা। যশোরের করোলা চাষীরা নতুন জাতের এই করলা বীজ সংগ্রহ করে চাষাবাদ শুরু করেছেন। চুড়ামনকাঠি, চৌগাছা ও ঝিকরগাছা এলাকায় নতুন জাতের এই দুই করোলা কৃষক চাষ করে সফলতা পেয়েছেন। প্রতি বিঘায় ৯৪.৫ মন করলা উৎপাদনে চমক দেখিয়েছে কৃষক। ঝিকরগাছা উপজেলার আটুলিয়ার কৃষক মোমিনুর রহমান জানান, দেশি উচ্ছে ও করলা চাষ করাটা এই এলাকার কৃষকের পুরাতন নেশা। কপোতাক্ষ নদের দুই তীরেই তা ব্যাপক আকারে চাষ হয়। ঝিকরগাছা উপজেলার শিমুলিয়া, ফতেপুর, আটুলিয়া, কায়েমকোলা, জামালপুর, দোসতিনা, অমৃতবাজার, শার্শার উলাশী, বেনাপোল, দৌলতপুর, পুটখালী, সাতমাইল, জামতলা, বাঁগাচড়া এলাকার বিভিন্ন মাঠে উন্নত প্রজাতির এই করলা চাষ হচ্ছে। যশোর সদর উপজেলার চুড়ামনকাঠি, বেলতলা, হামিদপুর, বাউলিয়া, ফতেপুর, চানপাড়া, বাঘারপাড়া উপজেলায়ও উন্নত এই করলা চাষ হচ্ছে। গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক প্রফেসর ড. হাসানুজ্জামান বলেন, নতুন উদ্ভাবিত জাতের ফসল ৪২ দিন সময় লাগে কিন্তু আগের গুলো হতে ৪৬ দিন সময় নিত। করলার গায়ের দাঁগ বা কাঁটার পরিমাণ তুলনামূলক কম হওয়ার কারণে পরিবহনে সুবিধা। এর একর প্রতি ফলন ১১.২ টন যা আগের তুলনায় ১.২ টন বেশি। প্রতিটি ফলের দৈর্ঘ্য ২৭ সে.মি. এবং ফলের ওজন ২৬০ গ্রাম। যা অন্যান্য জাতের তুলনায় বেশি। এ প্রসংগে ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. এম কামরুজ্জামান বলেন, অতি দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা কার্য সমৃদ্ধ করার প্রত্যয়ে ‘জিন ব্যাংক’ এবং ‘প্রযুক্তি গ্রাম’ প্রতিষ্ঠার আশ্বাস প্রদান করেন। এছাড়া তিনি কৃষি গবেষণা মাঠের উন্নয়ন, পাবলিক – প্রাইভেট নীতিমালা গ্রহণের বিষয়েও গুরুত্ব আরোপ করেন। উল্লেখ্য কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের প্রফেসর ড. মোঃ হাসানুজ্জামানের তত্ত্বাবধানে এর আগেও মিষ্টি কুমড়ার দুটি জাত (হাজী ও দানেশ) উদ্ভাবিত হয়েছে। উচ্ছে ও করলা তিতা বলে অনেকেই খেতে পছন্দ করেন না। তবে এর ঔষধি গুণ অনেক বেশি। ডায়াবেটিস, চর্মরোগ ও কৃমি সারাতে এটি ওস্তাদ সবি জবা তরকারি। ভিটামিন ও আয়রন-সমৃদ্ধ এই সবজির অন্যান্য পুষ্টিমূল্য অনেক। উচ্ছে ও করলা এ দেশের প্রায় সব জেলায় চাষ হয়। তবে সব্জী উৎপাদনে অন্যান্য জেলার তুলনায় যশোর যোজন যোজন এগিয়ে। আগে শুধু গরমকালে উচ্ছে-করলা উৎপাদিত হলেও এখন জাতের গুণে প্রায় সারা বছরই যশোরে তা চাষ হয়। যেগুলো অপোকৃত ছোট, গোলাকার, বেশি তিতা, সেগুলোকে বলা হয় উচ্ছে। বড়, লম্বা ও কিছুটা কম তিতা স্বাদের ফলকে বলা হয় করলা। উচ্ছে গাছ ছোট ও কম লতানো হয়। করলা গাছ বেশি লতানো ও লম্বা লতাবিশিষ্ট, পাতাও বড়। উচ্ছে ও করলা তিতা বলে অনেকেই খেতে পছন্দ করেন না। তবে এর ঔষধি মূল্য অনেক বেশি। বারি করলা ২ ঃ এটি একটি উচ্চ ফলনশীল জাত। গাঢ়সবুজ রং ও মাঝারী আকারের (৯৮ গ্রাম)ফল। ফলের গায়ে প্রচুর ছোট ছোট চোখা ডধৎঃ এবং ংঢ়রহব দেখা যায়। গাছ প্রতি গড় ফলের সংখ্যা ৩৮টি এবং গড় ফলন প্রায় ২১.১ টন/হেক্টর। বারি করলা ৩ ঃ এটি একটি উচ্চ ফলনশীল জাত। গাঢ় সবুজ রং ও মাঝারী আকারের (৯৮ গ্রাম) ফল। ফলের গায়ে প্রচুর ছোট ছোট চোখা ডধৎঃ এবং দেখা ংঢ়রহব যায়। গাছপ্রতি গড় ফলের সংখ্যা ৩৮টি এবং বারি করলা ৩ এটি একটি উচ্চ ফলনশীল জাত। সবুজ রং ও মাঝারী আকারের (৭৭ গ্রাম) ফল। ফলের গায়ে অল্পকিছু ছোট ছোট ভোতা ধিৎঃ দেখা যায়। গাছপ্রতি ফলের সংখ্যা ৪৫ টি এবং গড় ফলন প্রায় ২১ টন/হেক্টর। গড় ফলন প্রায় ২১.১ টন/হেক্টর। উৎপাদন প্রযুক্তি জলবায়ু ও মাটি ঃ উষ্ণ আর্দ্র আবহাওয়ায় করলা ভাল জন্মে। পরিবেশগত ভাবে এটি একটি কষ্ট সহিষ্ণু উদ্ভিদ। মোটামুটি শুষ্ক আবহাওয়ায় এটি জন্মানো যায়, তবে বৃষ্টিপাত- এর জন্য খুব তিকর নয়। তবে জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতে পরাগয়ন বিঘ্নিত হতে পারে। তাই শীতের দু’ এক মাস বাদ দিলে বাংলাদেশে বছরের যেকোন সময় করলা জন্মানো যায়।
উৎপাদন মৌসুম ঃ বছরের যে কোন সময় করলার চাষ সম্ভব হলেও এদেশে প্রধানত খরিফ মৌসুমেই করলার চাষ হয়ে থাকে। ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে যে কোন সময় করলার বীজ বোনা যেতে পারে। কেউ কেউ জানুয়ারি মাসেও বীজ বুনে থাকেন কিন্তু এ সময় তাপমাত্রা কম থাকায় গাছ দ্রুত বাড়তে পারে না, ফলে আগাম ফসল উৎপাদনে তেমন সুবিধা হয় না। পর্যাপ্ত সেচের ব্যবস্থা করতে পারলে আশাব্যাঞ্জক ফলন পাওয়া যায়। বীজের হার ঃ করলার জন্য হেক্টরপ্রতি ৬-৭ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়। জমি তৈরি ও বপন পদ্ধতি ঃ খরিফ মৌসুমে করলার জন্য এমন স্থান নির্বাচন করতে হবে যেখানে পানি জমার সম্ভাবনা নেই। বসতবাড়িতে করলার চাষ করতে হলে দু’চারটি মাদায় বীজ বুনে গাছ বেয়ে উঠতে পারে এমন ব্যবস্থা করতে হবে। বাণিজ্যিকভাবে চাষের জন্য প্রথমে সম্পূর্ণ জমি ৪-৫ বার চাষ ও মই দিয়ে প্রস্তুত করে নিতে হয় যাতে শিকড় সহজেই ছাড়াতে পারে। জমি বড় হলে নিদিষ্ট দূরত্বে নালা কেটে লম্বায় কয়েক ভাগে ভাগ করে নিতে হয়। বেডের প্রশস্ততা হবে ১.০ মিটার এবং দুই বেডের মাঝে ৬০ সেমি নালা থাকবে। করলার বীজ সরাসরি মাদায় বোনা যেতে পারে। এেেত্র প্রতি মাদায় কমপে ২টি বীজ বপন করতে হবে অথবা পলিব্যাগে (১০-১৫ সে.মি) ১৫-২০ দিন বয়সের চারা উৎপাদন করে নেওয়া যেতে পারে।
সারের পরিমাণ ঃ করলা চাষে জৈবসার খুব দরকার। মোট জৈবসারের অর্ধেক জমি চাষের সময় ও বাকি অর্ধেক বীজ বোনা বা চারা লাগানোর ১০ দিন আগে মাদায় দিতে হবে। অন্যান্য সার নিচের ছক অনুযায়ি দিতে হবে। অন্তর্র্বতীকালীন পরিচর্যা ঃ চারা লাগানোর থেকে ফল সংগ্রহ পর্যন্ত জমি সবসময় আগাছা মুক্ত রাখতে হবে। গাছের গোড়ায় আগাছা থাকলে তা খাদ্যোপাদান ও রস শোষণ করে নেয় বলে আশানুরূপ ফলন পাওয়া যায় না। সেচের পর জমিতে চটা বাঁধলে গাছের শিকড়াঞ্চলে বাতাস চলাচল ব্যহত হয়। কাজেই প্রত্যেক সেচের পর গাছের গোড়ার মাটির চটা ভেঙ্গে দিতে হবে। খরা হলে প্রয়োজন অনুযায়ী সেচ দিতে হবে। পানির অভাবে প্রাথমিক অবস্থায় চারার বৃদ্ধি বন্ধ হয়, পরবর্তীতে ফুলও ঝরে যায়। চারা ২০-২৫ সেমি উঁচু হতেই ১.০-১.৫ মি উচু মাচা তৈরি করতে হবে।
বাউনি দেয়া ঃ চারা ২০ থেকে ২৫ সেন্টিমিটার লম্বা হলে চারার সাথে কাঠি পুঁতে বাউনি দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি মাটি থেকে এক থেকে দেড় মিটার উঁচু করে মাচা তৈরি করতে হবে। যেহেতু বেড ১ মিটার চওড়া, সে জন্য মাচাও অনুরূপ চওড়া রাখলে ভালো হয়। এতে করলা তোলা ও পরিচর্যার কাজ সহজ হয়। বাঁশের শক্ত খুঁটি পুঁতে তার মাথায় জিআই তার, রশি ইত্যাদি বেঁধে খাঁচা তৈরি করে তার উপর দিয়ে পাটকাঠি বা বাঁশের সরু কাঠি ফাঁকা করে বিছিয়ে মাচা তৈরি করা যেতে পারে। মাটিতে লতিয়ে দেয়ার চেয়ে মাচায় লতিয়ে দিলে করলার ফলন ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বেশি হয়।
ফসল সংগ্রহ ঃ স্ত্রী ফুলের পরাগায়নের ১৫-২০ দিনের মধ্যে ফল খাওয়ার উপযুক্ত হয়। ফল আহরণ একবার শুরু হলে তা দুই মাস পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে।