দশমিনায় ভাসমান বেদে সম্প্রদায় নাগরিক সেবা থেকে বঞ্চিত

0
281

নাসির আহমেদ,দশমিনা (পটুয়াখালী) : পটুয়াখালীর দশমিনা উপজেলার বিভিন্ন সমতল ভূমিসহ খালে একদল ভাসমান বেদে সম্প্রদায় বসবাস করছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভাসমান অবস্থায় বসবাস করা এই সম্প্রদায় প্রতিনিয়ত নাগরিক সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সারা বছর নৌকায় অথবা বিভিন্ন সমতল ভূমিতে অস্থায়ী তাবুতে মানবেতর জীবনযাপন করছে। স্থায়ী কোন ঠিকানা পাওয়া না গেলেও নৌকায় তাদের বসবাস। এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় নৌকায় করে ছুটে চলা তাদের নিত্যদিনের সাথী। খালের পাশে এক একটি বেদে দলে ১০ থেকে ১৫ টি নৌকা সারিবদ্ধ হয়ে নোঙ্গর করে তারা জীবন ও জীবিকার জন্য কখনও বড়শি দিয়ে মাছ ধরা কিংবা পল্লী জনপদে গিয়ে ঝাড়ফুক ও সিঙ্গা লাগানোই তাদের প্রধান পেশা। আধুনিক যুগেও জীবনযুদ্ধে জীবিকার সন্ধানে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ান বেদেনীরা। ‘সিঙ্গা লাগাই, দাঁতের পোক ফালাই’- বেদেনীদের এখন সুর আর কারও মনে নাড়া দেয় না। আগের মতো কেউ আর চাল, ডাল, শাক-সবজির বিনিময়ে মাছ আনতে নদীর ঘাটে যান না। বদল প্রথা নেই আর এ সংসারে। অর্থের প্রবল নেশায় স্থলের মানুষেরা ভাতের সঙ্গে মাছ আর বস্ত্র আছে কিনা, খবর রাখে না কেউ। অসহায় হয়ে পড়েছে এসব মাছ ধরা লোকগুলো। বেদেরা স্থলে আর মানতাদের নদীতেই সংসার। কেমন আছে ঠিকানা বিহীন জীবনে এই যাযাবর বেদে ও মানতা সম্প্রদায়রা। নিজ ভূখণ্ডে বাস করেও যারা পরবাসী! সমাজ সভ্যতা গড়ার কাজে প্রতিনিয়ত নিবেদিত প্রাণের লোকগুলো কেমন আছে? বিষধর সাপ নিয়ে খেলা, বিষাক্ত জীবন নিয়েই তাদের বসবাস। এক সময় নৌকা নিয়ে নৌপথে চলাচল করত এ সম্প্রদায়রা। এখন নৌপথেই বাঁধ, স্লুইসগেট নির্মাণের ফলে নৌকা নিয়ে চলাচল একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে বেদেদের। বেদেরা এখন সড়কপথে এসে পথ থেকে প্রান্তরে জনগুরুত্বপূর্ণ হাট-বাজারের সংলগ্নে ছোট ছোট ঝুপড়ি ঘর তুলে বসবাস করে। সাপ খেলার পাশাপাশি বেদেনীরা তাবিজ-কবজ নিয়ে ঘুরে বেড়ায় গাঁয়ের মেঠোপথে। তবে দিন দিন এ বেদে সম্প্রদায় সাপ ধরার নেশা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। নানা পণ্য এখন তাদের হাতে উঠেছে। বেঁচে থাকার নিরান্তর সংগ্রমেই আজ তাদের ভিন্ন পথে চলা বৈকি। তারপরও যারা এ পেশাকে আগলে রেখেছে তাদের জীবন চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। তেমনই আশ্রয় নেয়া পটুয়াখালীর দশমিনা উপজেলা সদরের খালে ঠাঁই নিয়েছে একটি বেদেবহর। এই বহরে রয়েছে ১০টি পরিবার, তাদের মোট লোক সংখ্যা শতাধিক। এই বহরের সরদার মো. ফরিদ সরদার। কথা হয় সরদারের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমরা যাযাবর, সরকার আসে সরকার যায়, আমাদের মিলছে না কোনো ঠিকানা! আজ এখানে আছি, কাল ওখানে, বেদেবহরের মেয়েরাই আয়-রোজগার করে। মেয়েরাই সকালে জীবিকার জন্য দল বেঁধে বের হয়। গ্রাম থেকে গ্রামে ছুটে, সন্ধ্যার দিকে ফিরে আসে বহরে। পুরুষরা সারাদিন ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা করে। সরদার বললেন, সাপ খেলায় এখন আর পেট বাঁচে না। পুরুষরাও ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে আসতে শুরু করেছে অভাব-অনটনের কারণে। কেউ কেউ পুকুর-ডোবায় তলিয়ে যাওয়া সোনা-রূপা তুলে দেয়ার কাজ করে। বিক্রি করছে শাড়ি, চুড়িসহ প্রসাধনী। কেউ কেউ ভানুমতির খেলা ও জাদুমন্ত্র নিয়ে হাজির হচ্ছে হাট-বাজারে। নদীর কলতানে যাদের ঘুম ভাঙা আর ঘুমোতে যাওয়া তেমনি অপর একটি সভ্যতার নিগৃহীত সম্প্রদায় মানতারা। তেঁতুলিয়া-বুড়াগৌরাঙ্গ নদীর বাঁকে খালে তাদের দেখা মেলে। জন্ম থেকে নদীর জলে খেলা করতে করতে ওরা বড় হয়। এরকম একজন জসীম সরদারের স্ত্রী রুনু বেগম (৩৭)। ১৫ বছরের স্বামীর সংসারে হাল ধরতে নৌকার হাল ধরতে হয়েছে। কিশোরী বয়সের বিবাহিত জীবন আজ জীর্ণছিন্ন, রোগাক্রান্ত শরীর, পুষ্টিহীনতায় ভুগেও রুনু বেগম রেহাই পাচ্ছে না সংসার নামক যন্ত্রণা থেকে। ৬ সদস্যের পরিবারে ৪ সন্তানের জননী আজ। উপজেলার বগীর একই খালের আদম আলী (৩০)। ছদুসহ (৩৫) ৩০টির অধিক নৌকায় প্রায় পৌনে দু’শতাধিক লোকের বাস। এদের প্রত্যেকের গড়ে ৪-৫টি সন্তান রয়েছে। উপজেলার বিভিন্ন খালে রয়েছে এরকম প্রায় শতাধিক লোকের বসবাস। পুঁজি জোগানোসহ এ সম্প্রদায়ের মানুষের সাহায্য-সহায়তায় নেই সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ। তারা সব ধরনের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। তাদের ভোটের রাজনীতি নেই। কে জিতল আর কে হারল সে খবর তারা রাখে না ওরা। অথচ কয়েকশ’ বছর ধরে মানতা সম্প্রদায়ের মানুষকে যাযাবর চরিত্র নিয়ে সমাজ-সভ্যতায় তাদের অংশগ্রহণ। থেকে গ্রামে ছুটে, সন্ধ্যার দিকে ফিরে আসে বহরে। পুরুষরা সারাদিন বাচ্চাদের দেখাশুনা করে। সর্দাররা বংশক্রমেই সরদার হয়। সর্দারের দৃষ্টিতে অপরাধ করলে বেদে সমাজে জুতা পেটা, অর্থ দ-সহ নানা ধরনের শাস্তির বিধান রয়েছে। সরদার বললেন, সাপ খেলায় এখন আর পেট বাঁচে না। পুরুষরাও ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে অভাব অনটনের কারণে। কেউ কেউ পুকুর-ডোবায় তলিয়ে যাওয়া সোনা রূপা তুলে দেয়ার কাজ করে। কেউ দিচ্ছে বিভিন্ন রোগের ঝাড়-ফুঁক ও তাবিজ-কবজ। বিক্রি করছে শাড়ি, চুড়িসহ প্রসাধনী। কেউ কেউ ভানুমতির খেলা ও জাদুমন্ত্র নিয়ে হাজির হচ্ছে হাটবাজারে। বেদে বহরের বয়স্করা জানালেন, বেদের মধ্যে রয়েছে অনেক উপ-সমপ্রদায়। যেমন, মালবৈদ্য, বাজিকর, শালদার, বান্দরওয়ালা, সওদাগার, কুড়িন্দা, হাতলেহেঙ্গা, মিশ্চিয়ারি, গাড়লী। মালবৈদ্যরা প্রধানত সাপ খেলা দেখায় ও দাঁতের পোকা তোলে। বাজিকরেরা ম্যাজিক দেখায় ও জাদুটোনা করে। শালদার মাছ ধরে, নদী থেকে ঝিনুক তুলে মুক্তা বের করে এবং চুড়ি বিক্রি করে। তবে যৌতুকবিহীন এ বিয়েতে কাজী রেজিস্টার প্রয়োজন হয় না । নদীর কলতানে যাদের ঘুম ভাঙা আর ঘুমাতে যাওয়া তেমনি অপর একটি সভ্যতার নিগৃহীত সমপ্রদায় মানবতারা। তেঁতুলিয়া-বুড়াগেীরাঙ্গ নদীর বাঁকে খালে ওদের দেখা মেলে। জন্ম থেকে নদীর জলে খেলা করতে করতে ওরা বড় হয়। এরকম একজন জসীম সরদারের স্ত্রী রুনু বেগম (৩৭), ১৫ বছরের স্বামীর সংসারে হাল ধরতে নৌকার হাল ধরতে হয়েছে। কিশোরী বয়সের বিবাহিত জীবন আজ জীর্ণ ছিন্ন, রোগাক্রান্ত শরীর, পুষ্টিহীনতায় ভুগেও রুনু বেগম রেহাই পাচ্ছে না সংসার নামক যন্ত্রণা থেকে। ৬ সদস্যে পরিবারে ৪ সন্তানের জননী আজ। উপজেলার বগীর একই খালের আদম আলী (৩০), ছদু (৩৫)সহ ৩০টির অধিক নৌকায় প্রায় পৌনে দু’শতাধিক লোকের বাস। এদের প্রত্যেকের গড়ে ৪/৫টি সন্তান রয়েছে। উপজেলার বিভিন্ন খালে রয়েছে এরকম প্রায় শতাধিক লোকের বসবাস। জন্ম নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে নেই কোনো ধারণা। আর থাকবেইবা কি করে? ওরাতো নদীর জলে বসবাস করে, মাছ ধরে বিক্রি করে, চাল, ডাল কিনে খায়। পুঁজি যোগানোসহ এ সম্প্রদায়ের মানুষের সাহায্য-সহায়তায় নেই সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ। এরা সব ধরনের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। এদের ভোটের রাজনীতি নেই। কে জিতল আর কে হারল সে খবর তারা রাখে না ওরা। অথচ কয়েকশ’ বছর ধরে মানবতা সম্প্রদায়ের মানুষকে যাযাবর চরিত্র নিয়ে সমাজ-সভ্যতায় এদের অংশগ্রহণ। মানতবা সম্প্রদায় মূলত বড়শি ও ছোট ছোট জাল দিয়ে মাছ ধরে। পেটের ুধা মিটিয়ে সঞ্চিত অর্থের ওপর বড়শি, জাল কেনা আর নৌকা মেরামত নির্ভর করে। শিা কি এরা জানেনা। ভোটাধিকার প্রয়োগে নেই এদের আগ্রহ। এরকম সমাজ সভ্যতার অনেক কিছুই অজানা এই মানুষেরা নদীর কয়েক ফুট উঁচু ঢেউ কিংবা প্রকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে শক্ত হাতে নৌকা চালাতে পারে, নদী আর সাগর জলের আচর-আচরণ এদের নখদর্পণে। জলের মতি-গতির সাথে সখ্যতা এদের জন্মাধিকার। এরা দল বেঁধে বহর নিয়ে বঙ্গোপসাগরের গভীর থেকে শুরু করে সুন্দরবন এবং হাতিয়া, সনদ্বীপ, টেকনাফ পর্যন্ত মাছ ধরতে ঘুরে বেড়ায়। জনমানবহীন দ্বীপাঞ্চল সোনারচর, রূপারচর, জাহাজমারা, শীলেরচর, চর-পাতিলায় এদের অনেক সময় দেখা যায়। প্রাকৃতিক পরিবেশ রাও এদের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। এরা প্রধানত পোয়া, রামছোস (তাপসী), ট্যাংরা, গলসা, পাঙ্গাশ, কাওন প্রভৃতি মাছ ধরে। মইয়া জাল দিয়ে চিংড়ি মাছ ধরে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে। এ সমপ্রদায় প্রতিটি নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর মাছ ধরায় পারদর্শী। এতসব অবদানের পরেও মানতা সম্প্রদায় আমাদের সমাজের অন্তর্ভুক্ত নয়। নানা সমস্যা-সংকট এদের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে। এরা ভূখ-ের কয়েশ’ বছরের পুরনো বাসিন্দা হলেও এদের নেই কোনো প্রকার নাগরিক অধিকার। নেহাত ভেসে কচুরিপানা কিংবা নদীর জলে যওয়া খড়কুটোর মতোই মানবতারা আজীবন নদীর পানিতে ভেসে বেড়ায়। নাগরিক পরিচয় সংকট এদের প্রবল। এ সমপ্রদায়ের নাম স্বার করতে পারে এ ধরনের মানুষের সংখ্যা খুবই কম। শিশুদের স্কুলে যাওয়ার সুযোগ নেই। এছাড়া স্থায়ীই ঠিকানা না থাকায় এবং ভূমি সমস্যায় এ সমপ্রদায়ের মানুষের মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য। এ সম্প্রদায়ের মানুষের মৃত্যু হলে আগেকার দিনে কলা গাছের ভেলায় লাশ ভাসিয়ে দেয়া হতো। আজকের দিনেও নদীর পাড়ে বা কোনো ভূ-স্বামীর পরিত্যক্ত ভিটের দানকৃত ভূমিতে ঠাঁই মিলে যাযাবর লাশটির। কালের বিবর্তনে বেদে সম্প্রদায়রা ধীরে ধীরে হারিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here