মালিকুজ্জামান কাকা, যশোর : যশোর শহরের নাছিমা আক্তার। পড়াশুনা করেছেন ৪র্থ শ্রেণি পর্যন্ত। ২০১৭ সালে তিনি প্রথম কাগজ দিয়ে এই কলম তৈরি করেন। সেই কলম বাজারে বিক্রি করতে লোকলজ্জা কাজ করছিল। গত বছর ২০১৯ সালের জুনে অর্থনৈতিক সংকট চরম আকার দেখা দিলে সংশয় দূরে সরিয়ে নাছিমা প্রথম ১০০ পিস হাতে তৈরি কলম নিয়ে উপস্থিত হন যশোর সদরের বাহাদুরপুর স্কুলে। সেই শুরু। এখন যতই দিন যাচ্ছে নাছিমার পরিবেশ বান্ধব কলমে মানুষের আগ্রড় শুধুই বাড়ছে। ১৯৯২ সালে তার বিয়ে হয় বিডিআর সদস্য মীর রবিউল আলম বাচ্চুর সঙ্গে। ২০০০ সালে বাচ্চু অবসরে বাড়ি ফেরেন। স্বামীর অবসর গ্রহণের পর যৎ সামান্য কিছু টাকা পেয়েছিলেন। যৌথ পরিবারের সাংসারিক কাজে সেই টাকা ব্যয় হয়ে যায়। এরপর বিভিন্ন লোকের কাছ থেকে অর্ডার নিয়ে থ্রি পিস, শাড়ি আর নকশিকাঁথা সেলাই করে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করতে হয়েছে। ২০১৯ সালের জুনে অর্থনৈতিক সংকট চরম আকার দেখা দিলে সব সংশয় দূরে সরিয়ে নাছিমা প্রথম ১০০ পিস হাতে তৈরি কলম নিয়ে উপস্থিত হন যশোর সদরের বাহাদুরপুর স্কুলে। সেখানকার প্রধান শিককে তার তৈরি কলম দেখিয়ে সেগুলো বিক্রির অনুমতি চান। প্রধান শিক তার বক্তব্যে সন্তুষ্ট হয়ে খুব অল্পসময়ের মধ্যে সেগুলো শিার্থীদের কাছে বিক্রি করে দেন। ওই শিক তাকে পরামর্শ দেন, কলমগুলোতে যেন পরিবেশবান্ধব সিল লাগিয়ে দেওয়া হয়। এরপর থেকে তিনি ‘শুভ পরিবেশবান্ধব কলম’ সিলটি যুক্ত করে করে কলম বিক্রি করে সংসারের হাল ধরেছেন। পরিবেশবান্ধব কলম। নাছিমার দুই সন্তানের মধ্যে বড় মেয়ে ঢাকার একটি কলেজে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স পড়ছেন। ছেলে মীর নাঈম আলম শুভ এবছর এসএসসি পাস করেছে। নাছিমা জানান, ছোটবেলা থেকে হাতের কাজ করতে ভালো লাগতো। বাড়িতে বসেই কাগজ, কাপড় আর সুতো দিয়ে নানারকম জিনিস তৈরি করতেন শখের বসে। সেই শখ নাছিমার পরিবেশবান্ধব কলম তৈরিতে পেনের রিফিল, এ-৪ সাইজের রঙিন কাগজ, ফেভিকল আঠা, কালার স্টিকার, স্ট্যাপলার পিন ব্যবহার করা হয়। কলম তৈরি শেষে পরিত্যক্ত কাগজ দিয়ে তিনি ফুলদানি, অ্যাশ-ট্রেসহ বিভিন্ন জিনিস তৈরি করতে পারেন।এখন জীবিকার অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে পড়েছে। যশোর শহরের লোনঅফিস পাড়ায় নাছিমার বাড়িতে দেখা যায়, টিনশেড বাড়ির বারান্দায় বসে তিনি এই কলম তৈরি করেন। এ কাজে তাকে সহায়তা করছে ছেলে শুভ। সে কলম গুলো দোকানে দোকানে সরবরাহ করে। কলম বিক্রির টাকায় সংসারে মোটামুটি সচ্ছলতা এসেছে নাছিমার। ‘শুভ পরিবেশবান্ধব কলম’ প্রথম দিকে যশোরের বিভিন্ন শিা প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করতেন নাছিমা। করোনার কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় কলম বিপণনে একটু সমস্যা হয়। তবে এখন তিনি বিভিন্ন অফিস, আদালত এবং ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করছেন। পরিবেশবান্ধব কলম তৈরি করছেন নাছিমা। নাছিমা জানান, ‘প্রথমদিন সব কলম বিক্রি হওয়ায় আমার সাহস বেড়ে যায়, উৎসাহ পাই। এরপর যশোর সিটি কলেজ, ক্যান্টনমেন্ট কলেজ, ডা. আব্দুর রাজ্জাক কলেজ, এমএম কলেজসহ জেলার অন্যান্য শিা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ২০০ থেকে ২৫০ পিস কলম বিক্রি করি। তার মতে, দেশে প্রতিদিন হাজার হাজার প্লাস্টিকের কলম ব্যবহৃত হয়। সেইসব কলম মাটিতে ফেলে দেওয়া হয়, যা অপচনশীল। এ থেকে পরিবেশ নষ্ট হয়, মাটি ও বাতাস নষ্ট হয়। কিন্তু তার তৈরি কলমে কাগজের ব্যবহার হয়, কাগজ পচনশীল। সেকারণে ভোক্তাদের আগ্রহ থেকেই যায়। প্রতিদিন তিনি ২৫০’ কলম তৈরি করতে পারেন। প্রতিটি কলমি বিক্রি হয় ৫ টাকায়। খরচ-খরচা বাদ দিয়ে দেড় থেকে দুই টাকা থাকে তার প্রতি কলমে।
যশোরের সরকারি অফিসেও কলম দিচ্ছেন নাছিমা। সম্প্রতি তিনি যশোরের সরকারি কয়েকটি দফতরে গিয়ে কলম বিপণনে তার সহায়তা চান। কর্মকর্তারা তার কাছ থেকে কলম কেনেন এবং পরবর্তীতে তার অফিসে যত কলম প্রয়োজন তার সবই নাছিমার কাছ থেকে নেবেন বলে জানান। তিনি যশোর পুলিশ লাইন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যোগাযোগ রাখছেন কলম সরবরাহের জন্য।
নাছিমার ছেলে শুভ জানায়, মায়ের সঙ্গে সঙ্গে সেও কলম বিপণনে কাজ করে। যশোর পৌরপার্কসহ শহরের বিভিন্ন দোকানে গিয়ে সে এসব কলম বাজারজাত করে।