ডি এইচ দিলসান : যশোরসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চল মরণব্যাধী করোনার ভয়াল থাবায় বিপর্যস্ত। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে করোনান সংক্রমন। ডাক্তার, সাংবাদিকসহ সর্বস্তরের মানুষ এই মরণব্যাধীতে সংক্রমিত হচ্ছেন। ইতিমধ্যে এই অঞ্চলের ১৫জন চিকিৎসকসহ প্রায় দুই শতাধিক ব্যক্তি এই মরণব্যাধীতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। যার মধ্যে নারী ও শিশুরাও রয়েছেন।
ইতিমধ্যে যবিপ্রবি জেনাম সেন্টার ল্যাবে করোনা টেষ্ট শুরুর পর থেকে এই রোগে আক্রান্তদের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। চলতি মাসেই যশোরে ৫৫জন করোনা রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। এছাড়া ঝিনাইদহে ১০, কুষ্টিয়ায় ১২জন, চুয়াডাঙ্গায় ৮জন, নড়াইলে ১০জন,মাগুরায় ৭ জন, খুলনায় ১২জন, বাগেরহাটে ৫জন ও মেহেরপুরে ৪জন করোনা পজিটিল হয়েছেন। তবে আশার কথা হচ্ছে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সাতক্ষীরা জেলায় এখনো পর্যন্ত কোন করোনা রোগীর সন্ধান মেলেনি। তবে এই জেলায় প্রায় দেড় হাজারজনকে হোম কোয়ারেইন্টান ও ১৫৬ জনকে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেইন্টাইনে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ১০ জেলায় প্রায় ৫ হাজার জনকে হোম কোয়ারেইন্টাইনে এবং ৫ শতাধিক ব্যক্তিকে বিভিন্ন হাসপাতালে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেইন্টাইনে রাখা হয়েছে। আইসোলেশনে রাখা রোগীদের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। এদিকে আক্রান্তদের মধ্যে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যাই বেশি। চলতি মাসে যশোর ও নড়াইলে ১০ জন চিকিৎসকসহ ১৫জন স্বাস্থ্যকর্মী কোরানা রোগে আক্রান্ত হয়েছেন বলে স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।
অপরদিকে গতকাল যশোর জেনারেল হাসপাতালের ১১ চিকিৎসক, ১১ নার্সসহ মোট ২৮ কর্মীকে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়েছে। বুধবার হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের জারি করা অফিস আদেশে এই কথা জানানো হয়।
কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো ডাক্তার, নার্সসহ অন্য কর্মীরা করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়া রোগীদের কনটাক্টে এসেছিলেন। এই ২৮ জনকে হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. আরিফ আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নমুনা পরীক্ষা করতে বলা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এই হাসপাতালের সব জনবলকে পরীক্ষার আওতায় আনা হবে।
এদিকে, গতকাল বুধবার যশোর বিশ্ববিদ্যালয় জেনোম সেন্টার থেকে পাঠানো ফলাফলে সদর উপজেলার যে চারটি নমুনা পজেটিভ বলে শনাক্ত হয়েছে, তার সবগুলোই যশোর জেনারেল হাসপাতাল কানেকটেড।
ডাক্তারসহ ২৮ জনবলকে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানোর নির্দেশ মঙ্গলবার স্বাক্ষর করা হয়। তবে তা গতকাল বুধবার থেকে কার্যকর হচ্ছে। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. দিলীপকুমার রায় এই তথ্য নিশ্চিত করে জানিয়েছেন, কোয়ারেন্টাইনের মেয়াদ হবে ১৪ দিন। এই সময়কালে তাদের সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ২৩ এপ্রিল যশোর জেনারেল হাসপাতালে সদর উপজেলার চুড়ামনকাটি এলাকা এবং ঝিকরগাছার দুই রোগী ভর্তি হন। একজন ছিলেন করোনারি কেয়ার ইউনিটে, অন্যজন মেডিসিন ওয়ার্ডে। দুইজনই তথ্য গোপন করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু লক্ষণ দেখে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আরো কয়েক রোগীর সঙ্গে ওই দুইজনের নমুনা নিয়ে ২৬ তারিখ পরীক্ষাগারে পাঠান। ২৭ এপ্রিল যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় জেনোম সেন্টার থেকে যে রিপোর্ট আসে, তাতে উল্লিখিত দুই ব্যক্তি করোনা পজেটিভ বলে চিহ্নিত হন। যাদের একজন মিডিয়াকর্মী।
এই পরিস্থিতিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে করোনারি কেয়ার ইউনিট ও মেডিসিন ওয়ার্ড লকডাউন করে দেন। গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট দুটি জীবাণুমুক্ত করার পদক্ষেপও নেওয়া হয়। ওই দুই স্থানে চিকিৎসাধীন রোগীদের স্থানান্তর করা হয় অন্য ওয়ার্ডে।
কিন্তু ইতিমধ্যে ওই দুই রোগীর সংস্পর্শে এসেছেন বেশ কিছু ডাক্তার, নার্স ও কর্মচারী। তাদের শনাক্ত করে হাসপাতাল প্রশাসন কোয়ারেন্টাইনে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন।
যে ১১ ডাক্তারকে কোয়ারেন্টাইনে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তারা হলেন, মেডিসিনের সহযোগী অধ্যাপক এবিএম সাইফুল আলম, কার্ডিওলজির জুনিয়র কনসালটেন্ট তৌহিদুল ইসলাম, মেডিকেল অফিসার মো. মাহামুদুল হাসান পান্নু, সহকারী রেজিস্ট্রার খালিদ শামস মো. শাহেদ জামীল, ইন্টার্ন ডাক্তার রুবেল, আজিজুর, প্রদীপ, রাজেশ, হৃদি, অর্পণ এবং সাজেদুল।
কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়েছে ১১ জন নার্সকেও। আরো রয়েছেন পরিচ্ছন্নতাকর্মী, ওয়ার্ড বয় ও আয়া মিলিয়ে ছয়জন। এছাড়া আগেই যশোর জেনারেল হাসপাতাল, চৌগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, মণিরামপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও শার্শাা স্বাস্থ্য কমপ্রেক্সে কর্মরত একাধিক ডাক্তার ও স্বাস্থ্য সহকারী ও নার্স করোনা রোগে আক্রান্ত হয়েছে নিজ নিজ বাড়িতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। অপরদিকে নড়াইলে করোনা পজেটিল হয়েছে ৫জন চিকিৎসকসহ ৮জন স্বাস্থ্য সহকারী। তাদেরকে নিজ নিজ বাসায় রেখে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হচ্ছে।
এদিকে, গতকাল বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনোম সেন্টার থেকে যে ১১ করোনা রোগী শনাক্ত হন, তাদের মধ্যে চারজন যশোর সদর উপজেলার। এই চারজনই জেনারেল হাসপাতাল কানেকটেড। এদের মধ্যে রয়েছেন একজন চিকিৎসকের স্ত্রী (৩৫)। নাক, কান, গলার বিশেষজ্ঞ ওই চিকিৎসক আগেই করোনা আক্রান্ত বলে শনাক্ত হন। পরে তার স্ত্রীকে জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। যদিও এই নারীর শরীরে কোনো উপসর্গ দেখা যায়নি। আক্রান্তদের আরেকজন হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের পিয়ন। শনাক্ত হওয়া অন্য দুইজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন, যাদের একজন সাংবাদিক। এই চার ব্যক্তির বাড়ি আজ বুধবার দুপুরেই লকডাউন করেছে প্রশাসন।
গত কয়েকদিনে শনাক্ত হওয়া করোনা পজেটিভদের বেশ কয়েকজনকে যশোর টিবি হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। যারা ওই হাসপাতালে যেতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেছেন, তাদের নিজ নিজ বাড়িতে চিকিৎসাধীন রাখা হয়েছে।
যশোর টিবি হাসপাতালকে অস্থায়ী করোনা হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এখানে করোনাভাইরাস আক্রান্তদের সেবার কাজে নিয়োজিতরা পাশেই নাজির শঙ্করপুরে অবস্থিত শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কের ডরমেটরিতে অবস্থান করছেন। ###