ডি এইচ দিলসান : যশোরের দুঃখ ভবদাহ অঞ্চলের কৃষিকাজের ২১টি ধাপের মধ্যে নারীরা ১৭টি ধাপের কাজ করে। তারপরও নারীরা কৃষক বা কৃষাণ হতে পারেননি। পুরষের চেয়ে বেশি কাজ করেও মজুরি বৈসম্যের শিকার হচ্ছেন তারা। সকাল থেকে সন্ধা পর্যন্ত কাদা মাটিতে জমি তৈরির কাজ করে একজন নারী পাচ্ছেন মাত্র ২০০ টাকা, সেখানে ওই নারীর থেকে কম কাজ করেও একজন পুরুষ কৃষক পাচ্ছেন ৪০০ টাকা। যদিও দীর্ষ দিন ধরে যশোরের নারী আন্দোলনকারীরা তাঁদের ‘নারী কৃষক’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছেন। একই সাথে পুরুষের সম পরিমান মজুরিও দাবি করেছেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ যশোর শাখার সাধারন সম্পাদক তন্দ্রা ভট্টাচার্যী।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফসলের প্রাক বপন-প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে ফসল উত্তোলন, বীজ সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ, বিপণনের অনেক কাজ নারী এককভাবে করেন। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক পরিসংখ্যানে নারীর এ হিসাবের স্বীকৃতি নেই। কৃষিকাজকে নারীর প্রাত্যহিক কাজের অংশ হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। ভাবা হয়, এ কাজে আবার মজুরি লাগবে কেন। কৃষি খাতে ৪৫ দশমিক ৬ শতাংশ কাজই নারীরা করেন বিনা মূল্যে।জরিপে দেখা গেছে, দেশে কৃষিকাজে নিয়োজিত শ্রমশক্তির সংখ্যা ২ কোটি ৫৬ লাখ। এর মধ্যে নারী প্রায় ১ কোটি ৫ লাখ। এক দশক আগেও নারীদের এ সংখ্যা ছিল ৩৮ লাখ। অর্থাৎ ১০ বছরের ব্যবধানে কৃষিকাজে যুক্ত হয়েছেন ৬৭ লাখ নারী। আর পুরুষের অংশগ্রহণ কমেছে সাড়ে ৩ শতাংশ।
অন্যদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত বাংলাদেশ শ্রমশক্তি বিষয়ক এক জরিপ বলছে, কৃষি অর্থনীতিতে গ্রামীণ নারীর অবদান ৬৪.৪ শতাংশ এবং পুরুষের অবদান ৫২.৮ শতাংশ। বিবিএসের অপর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এক দশকের ব্যবধানে দেশের কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে ১০২ শতাংশ। সেখানে পুরুষের অংশগ্রহণ কমেছে ২ শতাংশ। ২০০০ সালে দেশের কৃষিতে নারী শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৩৮ লাখ। ২০১০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ কোটি ৫ লাখে। প্রতিবেদন বলছে, ১০ বছরের মধ্যে প্রায় ৭০ লাখ নারী কৃষিতে যুক্ত হয়েছেন। কৃষির বিভিন্ন পর্যায়ে শ্রমবিভাজনের কারণে নারী শ্রমিকের চাহিদা বেড়েছে। বেশিরভাগ পুরুষ পেশা পরিবর্তন করে অ-কৃষিকাজে নিয়োজিত হচ্ছেন, কিংবা গ্রাম ছেড়ে পাড়ি জমাচ্ছেন শহরে। এই প্রতিবেদনে উপকূল এলাকার প্রতিফলন রয়েছে।
সোমবার যশোর ভবদাহ এলাকার বিল মান্দিয়াতে গিয়ে দেখা যায় ধান লাগানোর জন্য জমি প্রস্তুত করতে ব্যস্ত কৃষক। একটি জমিতে হাটু পানিতে নেমে জমি প্রস্তুত করছে রীতা রাণি, সিমা মন্ডল ও শিউলি মালা। তাদের সাথে ছিলেন অজিত মন্ডলও। কথা বললে সিমা মন্ডল বলেন, আমাদের মনির বাপ ও মাঠে জোন দেয় আমিও কিছু আয়ের জন্য মাঠে জোন দিই। তিনি বলেন মনির বাপ ৪০০ টাকিা মুজুরি পেলেও আমি পাই ২০০ টাকা। সাথে থাকা অজিত মন্ডল বলেন, এটাই নিয়ম, মহিলাদের গায়ে জোর কম তাই ওরা কম টাকা পাই। যদিও সিমা মন্ডল বলেন অজিত দা যে কাজ করে আমরাও ঠিক একই কাজ করি।নিম্ন আয়ের পরিবারে আর্থিক টানাপোড়েন কাটিয়ে উঠতে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও কাজে যোগ দেন। এটাই এ অঞ্চলের চিরায়িত রুপ।
সরেজমিনে পাওয়া তথ্যসূত্র বলছে, শুধু জমি প্রস্তুত নয় ধান কাটা , ধানের চারা রোপণ, ধান শুকানো, ধান মাড়াই, সবজি আবাদ, গরু-ছাগল পালনসহ বিভিন্ন ধরনের কাজে সম্পৃক্ত যশোরের ছিয়ানব্বই এলাকার নারীরা। পুরুষের অনুপস্থিতিতে নারী প্রধান পরিবারের ব্যক্তি নারী প্রধানত কৃষি কাজের মাধ্যমেই জীবিকা নির্বাহ করছেন। শুধু উৎপাদন নয়, একাধারে ফসল উৎপাদন প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বাজারজাতকরণের সঙ্গে জড়িত নারীরা। খাঁটুনি বেশি, কাজে ফাঁকির সুযোগ নেই, আবার কাজের সময়সীমাও বেশি- অথচ মজুরি কম। কৃষিতে নারীর অবদানের কোন স্বীকৃতিও নেই।
এ এলাকায় ফসলের মাঠে নারী কৃষকের দেখা মেলে। অন্যান্য স্থানে সবজি আবাদ, গরু-ছাগল পালন, মৎস্য খামার পরিচালনা, হাঁস-মুরগি পালন, ফসলের ক্ষেত নিড়ানি, মাঠের ফসল ঘরে তোলা ইত্যাদি কাজে অসংখ্য নারীকে দেখা যায়। নারী কৃষক সীতা রাণী বলেন, পুরুষের চেয়ে আমরা বেশি কাজ করি। কাজে ফাঁকি দেই না। বিড়ি-সিগারেট টানতে আমাদের সময় অপচয় হয় না। সময় ধরে কাজে আসতে হয়, যেতে হয়। তবুও আমাদের মজুরি কম। মালিক বলে, আমরা নারী, আমরা পুরুষের মত কাজ পারি না।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ যশোর শাখার সাধারন সম্পাদক তন্দ্রা ভট্টাচার্যী বলেন, জাতীয় কৃষি নীতিমালায় নারী কৃষকের সুস্পষ্ট সংজ্ঞা সংযুক্ত করে ‘কৃষক’ হিসেবে নারীদের কৃষি উপকরণ সেবা প্রাপ্তিতে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দিতে হবে। তাদের কাছে কৃষি সংক্রান্ত সব তথ্য পৌঁছাতে হবে। প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি বাজার ব্যবস্থায় গ্রামীণ নারীর অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করতে যথাযথ সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তিনি বলেন, স্থানীয় পর্যায়ের ভূমি মালিকেরা যাতে নারী কৃষকদের ন্যায্য মজুরি দিতে বাধ্য হয়, সে ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি মাঠ পর্যায়ে নারী কৃষকদের সংগঠন গড়ে তোলাও জরুরি।তিনি আরো বলেন নারীদের এই রোজগার পরিবারের অনটন ঠেকাতে সহায়তা করে। কিন্তু বাইরে নারীদের কাজের পরিবেশ নেই, তারা পাচ্ছেন না ন্যায্য মজুরি। কোথাও কোথাও পুরুষের অর্ধেক মজুরি দেয়া হয় তাদের। ভূমি মালিকদের অনেক লাঞ্ছনাও সইতে হয়।