জিএম অভি : ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলার ঘারুয়া ইউনিয়নের খামিনারবাগ গ্রাম থেকে দেড় বছর আগে নিখোঁজ হন আলোমতি (৪০)। চার সন্তানের জননী স্বামী পরিত্যক্তা হয়েছেন সেই কবেই। নতুন বিয়েও করেছেন স্বামী হাশেম আলী (৪৭)। চার সন্তানের মধ্যে পুত্র সন্তানটি নিয়ে গেছেন বাবা।বাকী তিনটি মেয়ের বোঝা কাঁধে করে জীবন সংগ্রাম পরিচালনা করছিলেন আলোমতি৷ নিজের দিনমজুর ভাই নুরু শেখের বাড়ীতে থাকতেন তিনি৷ সেখান থেকে প্রতিবেশি ও ভাইদের সহায়তায় তিনটি মেয়ের পাত্রস্থও করেছেন আলোমতি৷
এরপর মানসিক একাকিত্ব জেঁকেবসে আলোমতির মনে। ধীরে ধীরে মানসিক ভারসম্যহীন হয়ে পড়েন আলোমতি। প্রায়ই এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াতেন পাগলের বেশে। পরিবারের লোকজন খোঁজাখুজি করে আবার বাড়ী ফিরিয়ে আনতেন তাকে৷
দেড় বছর আগে ছোট মেয়ে রত্নার বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনাদেন আলোমতি। নিজ গ্রাম খামিনারবাগ থেকে ভাঙা চৌরাস্তায় এসে নিখোঁজ হন তিঁনি৷ সেই রওনা আর গন্তব্যে পৌঁছায়নি। এরই মাঝে পেরিয়ে গেছে ১৮ টি মাস। পরিবারের লোকজন অনেক খোঁজাখুঁজি করেছেন কিন্তু কোথাও খুঁজে পাননি। অবশেষে আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন পরিবারের সদস্যরা। তাঁরা ভেবে নিয়েছিলেন তিঁনি হয়ত আর বেঁচে নেই। কোথাও গিয়ে মারা গিয়েছেন।
হটাৎ একটি চমৎকার সেই আলোমতিকে আবিষ্কার করে যশোর সদর উপজেলার শেখহাটি তরফ নওয়াপাড়া গ্রামে৷ ভোরের সূর্য ফুঁটতেই আলোমতির আবির্ভাব ঘটে তরফ নওয়াপাড়া মোড়ের শেখ ফার্মেসির সামনে। গেল মঙ্গলবার (২৩জুন) সারাদিন সেখানেই বসে ছিলেন তিনি। তাকে দেখে স্থানীয়রা হামেশাই পাগল ভেবে ছিলেন৷ কেউ রুটিকলা কেউবা আবার দু পাঁচ টাকা দান করছিলেন তাঁকে। এভাবেই দিন গড়িয়ে যখন আঁধার নামে সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়।
সেই মুহুর্তে একই গ্রামের তরুন সালাহ্উদ্দীন সাগর (২৫) অজ্ঞাত পাগলীটির খোঁজ নিতে আসেন। পাগলীর সাথে কথা বলে জানতে পারেন তার বাড়ী ফরিদপুর খামিনারবাগ। এর বেশি কিছু তিনি আর বলছেন না৷
সালাহ্উদ্দীন সাগররা কয়েকজন মিলে মাস খানেক আগে “চ্যানেল দূর্জয়” নামে একটি অনলাইন ভিডিও পত্রিকা প্রকাশ করেছেন এবং অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য একটি টিমও গঠন করেছেন “টিম দূর্জয়”। মধ্য রাতে পাগলীটিকে উদ্ধার করার জন্য তিনি টিম দূর্জয়কে বার্তা পাঠান। এবং ৯৯৯ এর মাধ্যমে উপশহর পুলিশ ক্যাম্পের আইসি এসআই আব্দুল লতিফের সহায়তা চান।
আব্দুল লতিফ এ এস আই ফিরোজের নেতৃত্বে একটি টিম ঘটনাস্থলে পাঠান । এর মধ্যে টিম দূর্জয়ের সদস্যরাও পৌঁছেযান ঘটনাস্থলে। রাত তখন ১২টা৷ পুলিশ গিয়ে স্থানীয় ইউপি সদস্য মিলন হোসেনকে ঘটনাস্থলে ডাকলে তিনি ব্যাপক অনিহা প্রকাশ করতে থাকেন, এক পর্যায়ে উদ্ধার তৎপরতায় সহায়তা না করে উল্টে পুলিশক সদস্যদের বলেন আপনারা আসছেন সারা রাত বসে পাহারা দেন। ঘুম কামাই করে এসব করার সময় নেই আমার। এদিকে পুলিশ সদস্যদের পিপিই না থাকায় তারাও মহিলাটিকে উদ্ধার করতে পারছিলেন না৷
এসকল সিমাবদ্ধতার কথা টিম দূর্জয়কে জানালে টিমের প্রধান সাগর তাৎক্ষণিক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কামরুজ্জামানকে জানান এবং উপজেলা স্বাস্থ্যটিম কে আসার অনুরোধ করেন। রাত গভীর হওয়ায় ইউএনও সম্মত থাকলেও স্বাস্থ্যকর্মীরা আসতে রাজী হননি৷
পরিস্থিতি অনুকুলে নেই বুঝতে পেরে পুলিশ সহ পুরো টিমের নেতৃত্ব দেন ২৫ বছর বয়সী এই তরুণ সালাহ্উদ্দীন সাগর। তিনি ও তাঁর টিমের সদস্যরা হাতে হ্যান্ডগ্লাভস ও জীবাণুনাশক ছিটিয়ে মহিলাটিকে উঠিয়ে বসান এবং পুণরায় মহিলাটির সাথে সন্তানসুলভ আচরণ করে ফোন নাম্বার ও বিস্তারিত ঠিকানা জানতে চান। তখন তিনি দুটো কথা বলেন তার স্বামী হাশেম আলী আর ইউনিয়ন ঘারুয়া। এরপর আর মুখ খোলেননি তিনি৷ তখন এটুআই ওয়েবসাইট থেকে ঘারুয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু ইব্রাহিমের নাম্বার সংগ্রহ করে তার সাথে যোগাযোগ করেন সাগর। চেয়ারম্যানের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে আলোমতির ভাই সেনাবাহিনীর ওয়ারেন্ট অফিসার (রিটায়ার্ড) আলী শেখের সাথে যোগাযোগ কথা বললে প্রাথমিক তথ্যের উপর ভিত্তি করে আলোমতিকে শনাক্ত করেন তার ভাই আলী।
আলী শেখ জানান, তিনি দেড় বছর আগে নিখোঁজ হয়েছেন৷ তাঁরা অনেক খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে অবশেষে হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। তাঁরা ভেবেছিলেন তিনি মারা গেছেন৷ আলী শেখ টিম দূর্জয়কে তার বোনকে উদ্ধারের অনুরোধ জানিয়ে বলেন আমরা আগামিকাল (বুধবার) যশোর এসে আলোমতিকে নিয়ে যাব
এরপর ২৫ বছরের সেই টগবগে তরুণ সালাহ্উদ্দীন সাগরের নেতৃত্বে টিম দূর্জয়ের সদস্যরা গভীর রাতে একজন অটোচালক কে বাসা থেকে ডেকে তুলে আনেন। এবং আলোমতিকে উদ্ধার করে যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করেন৷ হাসপাতালের যাবতীয় খরচ বহণ করেন চ্যানেল দূর্জয় ও টিম দূর্জয়ের প্রধান নির্বাহী সালাহ্উদ্দীন সাগর। সেখানে চিকিৎসাধীন থাকাবস্থায় গতকাল বুধবার আলোমতির দুই ভাই আলী শেখ (৫০) ও নুরু শেখ (৪৮) উপস্থিত হয়ে তাঁদের বোন কে সনাক্ত করেন৷ হাসপাতালের যাবতীয় প্রক্রিয়া শেষ করে উপশহর পুলিশ ক্যাম্পের আইসি এসআই আব্দুল লতিফের মাধ্যমে আলোমতিকে তাঁর পরিবারের নিকট হস্তান্তর করেন সালাহ্উদ্দীন সাগর।
উপশহর পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ এসআই আব্দুল লতিফ বলেন, সালাহ্উদ্দীনদের সঠিক মূল্যয়ন করে চেতনা গুলো বাঁচিয়ে রাখতে হবে৷ ওরা এরকম একটি মহৎ কাজে যে সাহসীকতা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে আমি ব্যক্তিগতভাবে ওদের ধন্যবাদ জানাই।
এ প্রসঙ্গে আভিযানিক টিমের প্রধান পুলিশ সদস্য এ এস আই ফিরোজ বলেন, আমার গোটা সার্ভিস লাইফে সালাহ্উদ্দীন সাগরের মত একটা ছেলে আমি দেখিনি। ও যে এত কম বয়েসে এত অল্প সময়ে এত চমৎকার ভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছে আমি ওর বাবার আদর্শ কে সাধুবাদ জানায়। কেননা প্রডাক্ট বলে দেয় কোম্পানির গুণমান। আমি সালাহউদ্দীন সাগর সহ ওর টিমের সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি৷ একই সাথে সমাজের সকল তরুণদের এ সকল কাজে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই। নিখোঁজ হওয়া আলোমতির ভাই আলী শেখ টিম দূর্জয়ের প্রশংসায় আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন, তিনি আনন্দে কেঁদে বলেন আমার বোনকে ফিরে পাবো কোনদিন ভাবিনি। তারা আমার বোনকে যেভাবে ফিরিয়ে দিয়েছেন আমরা তাঁদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ। আমি টিম দূর্জয়ের জন্য অন্তর থেকে দোয়া করি৷
৪নং নওয়াপাড়া ইউনিয়ন আ’লীগের যুগ্ম সম্পাদক ওসমান গণি তুষার বলেন, আমি ঘটনাস্থলে ছিলাম, সালাহউদ্দীন সাগর যে কাজ করেছে নিঃসন্দেহে ভালকাজ৷ গভীর রাতে প্রশাসনের লোক ডেকে নিজে কোথাকার কোন পাগলী তাঁর জন্য যে পরিশ্রম ও অর্থ দিয়েছে তা আজকের সমাজে বিরল ঘটনা৷ সমাজের সকল ভাল কাজে ওকে পাওয়া যায়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি ইউপি সদস্য মিলন হোসেন সম্পর্কে বলেন, দায়িত্ব ছিল জনপ্রতিনিধি হিসেবে মেম্বারের। কিন্তু সে দায়িত্ব পালন তো দূরের কথা বরং অসংলগ্ন কথা বার্তা বলে উদ্ধার অভিযানে আরও বিলম্ব ঘটিয়েছে। একটা অথর্ব লোক মিলন। ওর সম্পর্কে মন্তব্য করাটাও লজ্জাজনক।
উদ্ধার অভিযানে আরও অংশ নেন ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি ও কমিউনিটি পুলিশিং ফোরামের উপদেষ্টা শহিদুল ইসলাম, টিম দূর্জয়ের সদস্য আব্দুল্লাহ আল সাকিব, ত্বকি তাহমিদ, মাহফুজ আলম, মনিরুল ইসলাম শোভন। স্থানীয় দু যুবক আব্দুল্লাহ ও আল আমিন।