মালিকুজ্জামান কাকা, যশোার : যশোর জুড়ে ১৮টি প্রতারক প্রতিষ্ঠান দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে এহসান এসের তিন অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। এরা ৩২২ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা বেশি আলোচিত হলেও ধর্মকে ব্যবহার করে মানুষের আরও কয়েক কোটি টাকা লোপাট করেছে ১৮ সমবায় নামধারী প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে আজিজ কোঅপারেটিভ কমার্স এন্ড ফাইন্যান্স ক্রেডিট সোসাইটি লিমিটেড, সেবক, প্রত্যয়, প্রাইম, যমুনা, উদ্যোগ, ম্যাক্সিম, মডার্ন, জনতা ও অগ্রণী মাল্টিপারপাস, পপুলার ইসলামী সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি এবং আল এহসান শরিয়া মাল্টিপারপাস, এহসান রিয়েল এস্টেট এন্ড ডেভলপমেন্ট লি: লগ্নিকারীদের একেবারে পথে বসিয়েছে। আজিজ কোঅপারেটিভ যশোর জেলার প্রায় ৪৫০ গ্রাহকের চার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে দেশের কয়েকটি শাখার গ্রাহকদের ১৫৯ কোটি টাকা আত্মসাৎ হয়েছে বলে আজিজ কোঅপারেটিভের ভয়াবহ চিত্র ধরা পড়ে। ওই ঘটনার পর থেকে যশোর শাখা স্থানীয় গ্রাহকদের এফডিআরসহ পাওনা টাকা ফেরত দিতে তালবাহানা শুরু করে। যশোরের খড়কির লগ্নিকারীরা জানান প্রতারণার শিকার হবেন তা কেউ আগে বুঝতে পারেননি। এদের একজন রফিকুল ইসলাম। তার মা, বড় ভাই ও নিজে গ্রাহক হন আজিজ কোঅপারেটিভ কমার্সের। প্রিন্সিপ্যাল অফিসার মনিরুল আলম রুবেলের কথায় বিশ্বাস করে কয়েক দফায় সাত লাখ ৭০ হাজার টাকা এফডিআর করেন তিনি। মূল টাকার দ্বিগুণ পাওয়ার প্রলোভনে পড়ে তিনি বাড়ি, জিনিসপত্র ও গরু ছাগল এমনকি জমি বিক্রি করে এখন পথে পথে ঘুরছেন। অর্থাভাবে মা বিনা চিকিৎসায় বিছানায় পড়ে আছেন।
আজিজ কোঅপারেটিভ কমার্স এন্ড ফাইন্যান্স ক্রেডিট সোসাইটি লিমিটেডের মতো বাকি নয়টি প্রতিষ্ঠান মানুষের আরও ২২ কোটি টাকা লোপাট করেছে। টাকা ফেরত দেবে বলে আজ না কাল করে বছরের পর বছর কাল পেন করে গা ঢাকা দিয়েছেন প্রতিষ্ঠান কর্মকর্তারা। তাদের এই চক্রের জালে ফেঁসে যশোরের অন্তত: ৪০০ গ্রাহক পথে বসে এখন চোখের জল ফেলছেন। নানা মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে পাবলিকের টাকা হাতিয়ে নেয়া এই ১০ মাল্টিপারপাসের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তবে, হোতারা কেউ জামিনে, কেউ আত্মগোপনে। গ্রাহকদের টাকা ফেরতের কোনো পথ দেখা যায়নি। এদের বাইরে রয়েছে আরো ৮/৯টি মাল্টিপারপাস প্রতিষ্ঠান যাদের কাছে গ্রাহক কোটি কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। জানা যায়, যশোর শহরের আরএন রোডে বদরুল আলমের নেতৃত্বাধীন সেবক মাল্টিপারপাস চার কোটি ৩৩ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছে। বিরামপুরের ওয়ালিদ খান ওরফে আব্দুল হান্নান ও নুরে আলমের নেতৃত্বাধীন প্রত্যয় মাল্টিপারপাস বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে নিয়েছে ছয় কোটি টাকা। যশোর মাইকপট্টিতে এম কামরুজ্জামানের নেতৃত্বে পরিচালিত পপুলার মাল্টিপারপাস আত্মসাৎ করেছে প্রায় এক কোটি টাকা। আরএন রোডে রিয়াজুল ইসলাম রাজু পরিচালিত প্রাইম মাল্টিপারপাস আত্মসাৎ করেছে দুইকোটি টাকা। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন রোডের মামুনুর রশিদের নেতৃত্বাধীন যমুনা মাল্টিপারপাস আত্মসাৎ করেছে আরো প্রায় দুই কোটি টাকা। বেজপাড়ার নলডাঙ্গা রোডে মিজানুর রহমান পরিচালিত উদ্যোগ মাল্টিপারপাস আত্মসাৎ করেছে এক কোটি ৩৪ লাখ টাকা। এমকে রোডের সরদার প্লাজায় ম্যাক্সিম মালিটপারপাস পরিচালক বহুল বিতর্কিত মফিজুল হক চক্র আত্মসাৎ করেছে পাঁচ কোটি ১৮ লাখ টাকা। আরএন রোডের সেলিম রেজা পরিচালিত মডার্ন মাল্টিপারপাস আত্মসাৎ করেছে ২৯ লাখ টাকা। যশোরের এমকে রোডের হাফেজ মাওলানা ইব্রাহিমের নেতৃত্বাধীন আল এহসান শরিয়া মাল্টিপারপাস গ্রাহকদের দুই কোটি ৯৫ লাখ ৫৪ হাজার ২০৪ টাকা আত্মসাৎ করেছে। যমুনা ও প্রাইম মাল্টিপারপাসে লগ্নিকারী প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সাবেক উপ-পরিচালক শহরের চাঁচড়া ডালমিল এলাকার আমজাদ হোসেন। তিনি জানান, তিনিসহ বিভিন্ন এলাকার শতাধিক মানুষের দুই কোটি টাকা আত্মসাৎ করা মামুনুর রশিদ ও আশরাফ হোসেন চক্র শুরুতেই যশোরের বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার মসজিদের ইমামকে কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত করেন। তাদেরকে মোটা অঙ্কের কমিশনের আশ্বাস দিয়ে গ্রাহক সংগ্রহের জন্য বলা হয়। জমাকৃত টাকার দ্বিগুণ মুনাফা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে টাকা সংগ্রহ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন সংশ্লিষ্টরা। নগদ কমিশন পাওয়ার আশায় নামাজের পর মসজিদের ভিতরেই মাল্টিপারপাস সম্পর্কে বয়ান শুরু করতেন ইমামদের অনেকে। ধর্মপ্রাণ মুসলমানসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের কাছ থেকে বিভিন্ন মেয়াদে কয়েক কোটি টাকা জমা হয়ে যায় ওই তহবিলে। এক পর্যায়ে লভ্যাংশ ও মূল টাকা ফেরত দেয়া বন্ধ করে দেন তারা। আর এসময় দিশেহারা হয়ে পড়েন গ্রাহকরা। এভাবে চলতে চলতে রাতের আঁধারে কোনো ঘোষণা বাদেই লাপাত্তা হয় যমুনা ও প্রাইম মাল্টিপারপাসের কর্মীরা। লগ্নিকারী সংগ্রাম কমিটির সাধারণ সম্পাদক বারান্দিপাড়া কদমতলার মফিজুল ইসলাম ইমন বলেন, মানুষের বিশ^াসের সুযোগ নিয়ে ইসলামী আদর্শের সাথে বেঈমানী করে কোটি কোটি টাকা পকেটে নিয়ে পালিয়েছে প্রতারকরা। যশোরে দুই গ্রাহকের ৩২ লাখ টাকা আত্নসাতের অভিযোগে এহসান রিয়েল স্টেট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের চেয়ারম্যানসহ ২৬ জনের নামে মামলা হয়েছে। অতিরিক্ত চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মারুফ আহম্মেদ পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে মামলাটি তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে বলেছেন। গ্রাহকরা হলেন, যশোর শহরের চাঁচড়া ডালমিল এলাকার আব্দুস সামাদের স্ত্রী রহিমা খাতুন (৭২) ও সদর উপজেলার সতীঘাটা কামালপুর গ্রামের তুরফান গাজীর ছেলে ওসমান গাজী (৭০)। তাদের পে মামলাটি করেছেন শহরের পশ্চিম বারান্দীপাড়া কদমতলা এলাকার রবিউল ইসলামের ছেলে মফিজুল ইসলাম ইমন। আসামিরা হলেন, এহসান রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের চেয়ারম্যান চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার নিশ্চিন্তপুর গ্রামের বাসিন্দা মুফতি আবু তাহের নদভী, প্রধান নির্বাহী ব্যবস্থাপক মাগুরার সাজিয়ারা গ্রামের বাসিন্দা কাজী রবিউল ইসলাম, ব্যবস্থাপক শিমুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা জুনায়েদ আলী, পরিচালক রাউতলা গ্রামের বাসিন্দা আজিজুর রহমান, পরিচালক কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার লীধরদিয়াড় গ্রামের বাসিন্দা মঈন উদ্দিন, পরিচালক খুলনার লবনচরা হরিণটানা রিয়াবাজার এলাকার বাসিন্দা মুফতি গোলাম রহমান, পরিচালক গাজীপুরের টঙ্গী উপজেলার চড়মাটিন এলাকার বাসিন্দা আব্দুল মতিন, মহাপরিচালক (প্রশাসন) সাতীরার কালিগঞ্জ উপজেলার খুবদিপুর এলাকার বাসিন্দা আমিনুল হক, চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার লিচুবাগান জামালখান রোডের বাসিন্দা কলিমুল্লাহ কলি, পরিচালক খুলনার খানজাহান আলীর শিরোমনি এলাকার বাসিন্দা মিজানুর রহমান, পরিচালক যশোর সদর উপজেলার রামনগর গ্রামের বাসিন্দা মুফতি মো. ইউনুস আহম্মেদ, পরিচালক খুলনার পাইকগাছা উপজেলার মরল এলাকার বাসিন্দা মনিরুল ইসলাম, পরিচালক মাগুরা সদর উপজেলার শিমুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা আইয়ুব আলী, পরিচালক যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার ধান্যপাড়া গ্রামের বাসিন্দা সামসুজ্জামান টিটু, ব্যবস্থাপক (যশোর শাখা) মাগুরার শিমুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা আতাউল্লাহ, যশোরের কেশবপুর উপজেলার বেতিখোলা গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল হালিম, মাঠকর্মী যশোর শহরের কারবালা রোডের বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম (সোনামিয়া), উপশহর এ-ব্লক এলাকার বাসিন্দা শামসুর রহমান, সমন্বয়কারী সেক্রেটারি যশোর শহরতলীর শেখহাটি জামরুলতলা এলাকার বাসিন্দা বাবুর আলী, একই এলাকার বাসিন্দা আব্দুল হক, শার্শা উপজেলার তেবাড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা এস এম সেলিম উল চৌধুরী, বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার সুন্দরকাটি গ্রামের বাসিন্দা মোকসেদ আলী, যশোরের রামনগর গ্রামের বাসিন্দা মুফতি ফুরকান আহমেদ, চাঁদপুর সদরের বিষ্ণুপুর গ্রামের বাসিন্দা লোকমান হোসেন, যশোর শহরের পুলিশ লাইনস টালিখোলা এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ আলী ও উপশহর ই-ব্লকের বাসিন্দা আক্তারুজ্জামান। মোছা. রহিমা খাতুনের পে দায়ের করা মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে, ১৭ নম্বর আসামি সিরাজুল ইসলাম তারও পূর্ব পরিচিত। তার প্রলোভনে পড়ে রহিমা খাতুন ২০১৩ সালের ১ আগস্ট থেকে ২০১৪ সালের ১ জুলাই পর্যন্ত বিভিন্ন সময় ওই কোম্পানিতে মোট ১৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা লগ্নি করেন। কিন্তু কোম্পানির কর্মকর্তারা তাকে মুনাফা দেননি। এ কারণে তিনি তাদের কাছে আসল টাকা ফেরত চান। আসামিরা তাকে টাকা ফেরত দিতে নানা তালবাহনা করতে থাকেন। একপর্যায়ে তারা তাকে টাকা ফেরত দিতে অস্বীকার করেন। এ কারণে আদালতের আশ্রয় নেয়া হয়েছে। ওসমান গাজীর পে দায়ের করা মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে, আসামিরা প্রতারক, ধাপ্পাবাজ। ধর্মের নাম ভাঙ্গিয়ে সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করে বিভিন্নভাবে অর্থ আদায় করে তা তারা আত্মসাত করে থাকেন। মামলার ১৭ নম্বর আসামি সিরাজুল ইসলাম ভুক্তভোগী ওসমান গাজীর পূর্ব পরিচিত। তিনি উল্লিখিত কোম্পানির মাঠকর্মী সেক্রেটারি পরিচয় দিয়ে তাকে অর্থ লগ্নি করতে উৎসাহ দেন। তাকে বলা হয়, কোম্পানিতে লগ্নিকৃত অর্থের সমপরিমাণ মুনাফা দেয়া হবে। তার প্রলোভনের পড়ে ওসমান গাজী ২০১০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৪ সালের ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত বিভিন্ন সময় কোম্পানিতে মোট ১৮ লাখ ৬০ হাজার টাকা লগ্নি করেন। কিন্তু উল্লিখিত আসামিরা প্রতিশ্রুতি অনুযায়ি তাকে মুনাফা দেননি। এ কারণে তিনি তাদের কাছে আসল টাকা ফেরত চান। কিন্তু তারা আজ দেব, কাল দেব বলে এভাবে দীর্ঘদিন ধরে ঘোরাতে থাকেন। সর্বশেষ চলতি বছরের ২০ আগস্ট তাদের কাছে লগ্নিকৃত টাকা ফেরত চাইলে তারা তা দিতে অস্বীকার করেন। যশোর সদর উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা রঞ্জিত কুমার দাশ এসব বিষয়ে জানান, তার দপ্তরে কমপে দেড় ডজন মাল্টিপারপাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছিল। তিনি নিজে মাঠ পর্যায়ে তদন্তে গিয়ে হতবাক হন। বন্ধ পান অধিকাংশ। ওই প্রতিষ্ঠানগুলো ঢাকা জয়েন্ট স্টক ও বিভাগীয় নিবন্ধকের কাছ থেকে অনুমোদন নিয়ে শাখা খুলেই সম্পূর্ণ বিধি বহির্ভূতভাবে ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করে। এদের মাঠে টাকা কম থাকে, লোকাল ব্যাংক একাউন্ট প্রায় শুন্য বা শূন্য থাকে। সব টাকা তাদের কেন্দ্রীয় পরিচালকের পকেট কমিটির একাউন্টে ঢোকে। যে কারণে বিশাল অঙ্কের টাকা নিয়ে লাপাত্তা হতে পেরেছে এসব প্রতিষ্ঠান।