লিবিয়ায় নিহত যশোরের রাকিবুলের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম

0
528

নূর ইসলাম, যশোর থেকে : ‘আমাগের সংসারের আর স্বচ্ছলতা ফিরানো লাগবে না বাজান। তুই ফিরে আই বাজান, ফিরে আই! আমার নাড়ি ছেঁড়া ধনরে আপনারা আনি দেন।’ এসব কথা বলে আর্তনাদ করে চলেছেন যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার খাটবাড়িয়া গ্রামের এক অভাগা মা মাহেরুন নেছা বেগম। আদরের ছোট ছেলে রাকিবুল ইসলাম রাকিবকে (২০) হারিয়ে অবিরাম কেঁদে চলেছেন তিনি। লিবিয়ার দণিাঞ্চলীয় মিজদা শহরে একটি মানবপাচারকারী চক্র গত বৃহস্পতিবার ২৬ বাংলাদেশিসহ ৩০ অভিবাসীকে গুলি করে হত্যা করে। তাদেরই একজন এই রাকিবুল ইসলাম রাকিব। তার ডাক নাম রাকিবুল। যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার খাটবাড়িয়া গ্রামের ভুমিহীন কৃষক ইসরাইল হোসেনের ছেলে রাকিবুল ইসলাম রকি(২০)। তার মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকে খাটবাড়িয়া গ্রামে চলছে শোকের মাতম। একদিকে ছেলে হারানোর শোক, অন্যদিকে ধার-দেনা মাথায় নিয়ে পাগলপ্রায় রাকিবের বাবা-মাসহ পরিবারের সদস্যরা। একটু সুখের আশায় ধার দেনা করে ৭ লাখ টাকা খরচ করে ছেলে রাকিবুলকে বিদেশ পাঠায় কৃষক বাবা ইসরাইল। কিন্তু সেই সুখের আশা আজ দুঃখের বিষাদে পরিণত হয়েছে।
শনিবার (৩০ মে) দুপুরে খাটবাড়িয়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, আদরের ছোট ছেলেকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ বাবা ইসরাইল হোসেন ও মা মাহেনুর নেছা বেগম। ছেলের মরদেহ এক নজর দেখার আকাঙ্খায় তাদের আহাজারি যেন কিছুতেই থামছে না। এলাকার শত শত নারী পুরুষ ছুটে এসেছে তাদের সান্তনা দেয়ার জন্য। চার ভাইবোনের মধ্যে রাকিবুল সবার ছোট। এ কারণে তার মৃত্যুর খবরে মা-বাবা, ভাই- বোন মুষড়ে পড়েছেন। তাদের বাড়িতে এখন শোকের মাতম চলছে।
রাকিবুলের বড় ভাই সোহেল রানা জানান, উন্নত জীবনের আশায় সাড়ে ৪ মাস আগে দেশ ছেড়েছিলেন রাকিবুল। ভালো কাজের জন্য সম্পত্তি বিক্রি আর জমানো টাকা খরচ করে দালালের মাধ্যমে তাকে লিবিয়ায় পাঠানো হয়। কিন্তু শুরু থেকেই দালালেরা তার সঙ্গে খারাপ আচরণ করতে থাকে। পরে তাকে আটকে রেখে ১৭ মে মোবাইলে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। ওই টাকা দুবাই থেকে তারা নিতে চায়। ভাইয়ের মুক্তির জন্য ওই টাকা দিতে রাজিও হয়েছিলেন তারা। আগামী ১ জুন পর্যন্ত তাদের কাছ থেকে সময় নিয়েছিলেন। কিন্তু তার চাচাতো ভাই লিবিয়া থেকে ফোন করে জানিয়েছেন ২৬ বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে রাকিবুলও রয়েছেন। সোহেল রানা বলেন, ‘আমরা এখন কী করব কিছুই বুঝতে পারছি না। মরদেহ কবে দেশে আসবে তাও জানি না। রাকিবুলের বাবা ইসরাইল হোসেন বাকরুদ্ধ কন্ঠে জানান, রাকিবুল যশোর সরকারি সিটি কলেজে অর্থনীতি বিভাগের অনার্সের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিল। রাকিবুলের চাচাতো ভাই ফিরোজ হোসেন লিবিয়া প্রবাসী। ওই ভাই লিবিয়ায় থাকা আব্দুল্লাহ নামের এক বাংলাদেশি দালালের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। লিবিয়ার দালাল আব্দুল্লাহ’র মাধ্যমে ৭ লাখ টাকা চুক্তিতে প্রথমে ভারত থেকে দুবাই তারপর মিশর হয়ে লিবিয়ার মিজদা ( ত্রিপলি থেকে ১৮০ কিঃমি দূরে ) শহরে পৌঁছান রাকিবুল। এরপর ওই শহরে রাকিবুলকে আটকে রেখে ১৭ মে মোবাইলে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে দালাল আব্দুল্লাহ। তিনি আরও জানান, বিভিন্ন এনজিও থেকে লোন করে, ভিটেবাড়ি বিক্রি করে, গরু ছাগল বিক্রি করে প্রথমে দালালকে ৫ লাখ টাকা তারা দিয়েছিল। রাকিবুলের মুক্তিপণের বাকি টাকা জোগার করা হচ্ছিল। আগামী ১ জুন পর্যন্ত দালালদের কাছ থেকে সময় নিয়েছিলেন। কিন্তু এর আগেই রাকিবুলকে তারা মেরে ফেলেন। এখন সরকারের কাছে তাদের দাবি- দ্রুত আইনি প্রক্রিয়া শেষে রাকিবুলের মরদেহ যেন তারা বাড়িতে নিয়ে আসতে পারেন। রাকিবুলের মা মাহেরুন নেছা বলেন, ‘আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই। যারা আমার বুকের ধনকে কেড়ে নিয়েছে আমি তাদের বিচার চাই। ফাঁসি চাই।’ যশোর-২ (ঝিকরগাছা-চৌগাছা) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মনিরুল ইসলাম মনির জানান, নিহত রাকিবুলের মরদেহ দ্রুত দেশে আনতে প্রবাসী মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করা হচ্ছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here